মৃত্যুকে জেনেছিলেন কবি ✺ আহমেদ
সাব্বির
‘মন আছি
জানতে চেয়ো না এসে
আমার ভালো লাগা
সমুদ্রে গেছে ভেসে’
কবি
আক্তারুজ্জামান লেবু মারা যান ২১ শে মার্চ ২০২১ খ্রি.। আমি জানতে পারি তার ঠিক চার
দিন পর― ২৫ শে মার্চ। কবির মৃত্যু
সংবাদে অবাক হওয়ার কিছু ছিল না। বাস্তবতা আমাদের চিন্তাকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল
যে,
আমরা তার আগত প্রস্থানকে মেনে নিয়েছিলাম। হঠাৎ মৃত্যুর চেয়ে,
বার্তা দিয়ে আসা মৃত্যু অধিক যাতনার। মৃত্যুপথযাত্রীকে তার দৈহিক
মৃত্যুর পূর্বে নিজ স্বপ্নের মৃত্যু সহ্য করতে হয়। অসংখ্য স্বপ্ন, অসংখ্যবার মৃত্যু-যন্ত্রণা। মহাখালীর জীর্ণ এক ভাড়াটে ঘরে বসে কবি যখন
ইন্ডিয়ার বিমান ধরতে লাগেজ গোছাচ্ছিলেন, সেই দিন তার
চাকুরির পরীক্ষা ছিল। লাগেজে চিকিৎসা সংক্রান্ত ফাইল সাজাতে সাজাতে বললেন,
‘সাব্বির, বাঁচবো না জেনেও পরীক্ষাটা
দেওয়ার ইচ্ছে ছিল, শরীর নিতে পারবে না বলে যাওয়া হলো না!’
২০১৯
সালের অক্টোবরের ১৮ বা ১৯ তারিখ। ব্যক্তিগত কাজে ঢাকা গিয়ে মহাখালীতে এক বন্ধুর
মেসে আশ্রয় নিলাম। খানিক বিশ্রাম নিয়ে ফোন দিলাম কবিকে। কবি তখন ঢাকায়, উন্নত চিকিৎসার জন্য নিচ্ছেন ইন্ডিয়া যাওয়ার প্রস্তুতি। ফোন পেয়ে কবি
তার ঠিকানা দিলেন। সেই ঠিকানা আমাকে কতটা অবাক করেছিল তা আজ ছয় বৎসর পর এসেও
স্পষ্ট মনে আছে। কাকতালীয়ভাবে মহাখালীতে কবির অস্থায়ী নিবাস এবং আমার বন্ধুর মেসের
দূরত্ব ছিল মোটে পঞ্চাশ গজ। মাঝখানে দু'টো কংক্রিটের
স্তূপ। ফলত, সেই দিন হতে, ইন্ডিয়ার
ফ্লাইট ধরার আগ পর্যন্ত, সপ্তাহখানেক, ঢাকায় কবির সঙ্গী হওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার।
রাস্তায়
অল্প স্বল্প হাঁটাহাঁটি, মেডিকেল টেস্টের জন্যে
হসপিটাল যাওয়া, ওষুধ ক্রয় আর বদ্ধ ঘরে আড্ডা। এই ছিল
আমাদের রোজকার রুটিন। আমাদের আড্ডা বারবার কোথাও এসে আটকে যেত৷ শুষ্ক মুখে হাসি
ফুটত কদাচিৎ। পাশ ফিরে দেখা যেত দরজার পাশে নির্বাক দাঁড়িয়ে কবির মা। দৈনিক চারশো
টাকা ভাড়ার সেই ছোট্ট ঘরে আড়ালে চোখ মুছবার জায়গা নেই।
একদিন
দেখলাম কবির দূর সম্পর্কের চাচা বসে আছেন ঘরে। হাস্যোজ্জ্বল মুখ নিয়ে গল্প শুরু
করলেন। চিকিৎসা নিয়ে দু’একটা কথা বলল হয়ত, বাকি সময়
শোনাল গাজীপুরের শালবনে স্কুলের নামে বনভূমি আয়ত্তে আনার গৌরবময় গল্প! যাবার বেলায়
শিক্ষক হওয়ার প্রস্তাব দিল। বুঝলাম, চাচা ভীষণ কাজের।
রক্ত
দিতে কবিকে নিয়ে হসপিটালে গেলাম। ডোনার আমি নিজে। হিমোগ্লোবিন মেপে জানা গেলো
আপাতত প্রয়োজন নেই লাল ভালোবাসার। আমার রক্ত কবির শরীরে যেতে না পেরে আফসোসে বিলীন
হল। কবির মাকে ততদিনে চাচি বলে ডাকি। কেরোসিন চুলায় গরুর কলিজা ভুনা করছেন চাচি।
ডাক্তার খেতে বলেছে কি না। আমি আছি, তাই
বাধ্যতামূলক খেতে হবে আমাকেও। রান্না শেষ। তিনি পরম স্নেহে পরিবেশন করতে লাগলেন।
কবি যতটা খেলেন তারচেয়ে বেশি আমার প্লেটে তুলে দিলেন। মহাকালের গহ্বরে জীবন হারিয়ে
যাচ্ছে, কবি মেনে নিলেন, কিন্তু
তার সৃষ্টির ধ্বংস? মানবে না। ইমেইলে কবিতার পিডিএফ
পাঠিয়ে বললেন, ‘দেখো, হারিয়ে যেন
না যায়’।
মধ্যরাতে
ইন্ডিয়ার ফ্লাইট। একই সময়ে আমাকে ধরতে হবে পটুয়াখালী যাওয়ার সাকুরা বাস। মহাখালী
থেকে কবিকে বিমানবন্দরের গাড়িতে উঠিয়ে দিতে গিয়ে অনুভব করলাম ভেতরটা সত্যই খালী
হয়ে যাচ্ছে আমার। মাস চারেক পর। ফেব্রুয়ারির শেষে পটুয়াখালী থেকে ঢাকায় ফিরলাম।
ইন্ডিয়া থেকে ফিরে কবি অবস্থান করছে ঢাকাতেই। ফোনে যোগাযোগ করে বইমেলায় এলাম। ২০২০
সালের বইমেলার শেষ দিনে আমাদের শেষ দেখা হল। তৎসময়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় কবিকে নিয়ে
স্বল্প-বিস্তর চর্চা হলেও, সোহরাওয়ার্দীর মলিন ঘাস
সাক্ষ্য দেবে, কবি সেদিনও নিঃসঙ্গ ছিল।
বাড়ি
ফিরলাম মার্চের দ্বিতীয় দিন। করোনা ভাইরাসে আতঙ্কিত দুনিয়া। অল্পদিনের ব্যবধানে
সামাজিক দূরত্বের মারপ্যাঁচে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় মানুষ থেকে মানুষ। আমি বগুড়ায়, কবি গাইবান্ধায়৷ পাশের জেলা হলেও দেখা করা আর সম্ভব হয়নি।
লকডাউনের
সময় প্রায়শ ফেসবুকে কষ্ট মাখানো ‘কথা’ জানাতেন কবি। মৃত্যুর অপেক্ষায় থাকা মানুষের
ফেসবুক পোস্ট যে কতটা নির্মম হয়, তা কবির পোস্ট না
পড়লে হয়ত কোনোদিন জানতে পারতাম না। মাঝে মাঝে ফোন দিতাম, মেসেঞ্জারে
নক করতাম। অল্প স্বল্প কথা হতো। সে কী ভয়ংকর কথা! মৃত্যু, মৃত্যু এবং মৃত্যু! সইতে পারি না বিধায় কথা বলা বন্ধ করে দিলাম। কিছু
দুঃখ একান্ত নিজের হয়। আমি তাকে ভালোবাসি, তবু তার দুঃখ
ছোঁয়ার ক্ষমতা আমার ছিল না।
স্বার্থপর
আমি কবিকে ভুলে যেতে চাই। ভুলে যাওয়ার অভিনয় করি। কিন্তু ভুলে যেতে পেরেছি কি? একসময় অন্নসংস্থানের অজুহাতে সামাজিক মাধ্যম থেকে দূরে চলে যাই। নিজেকে
নিয়ে ব্যস্ত আমি ভীষণ। পৃথিবীর কোন কোণে কোন অসহায় কবি মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছে
সে খবর আমার কাছে তুচ্ছ! কিন্তু সেই হতভাগ্য কবিদের মাঝে যে আমার লেবু ভাই আছে,
আমি ভুলে গেছি!
২০২১
সালের ২৫ মার্চ। ফেসবুকে এসে প্রথম যে পোস্ট চোখে পড়েছিল, তা লেবু ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ। ততদিনে প্রিয়দের শোকে অনেকটা ভাটা পড়েছে।
তবুও আমি একলা ভেসে গেলাম দুঃখের জোয়ারে।
0 মন্তব্যসমূহ