মন
সায় দেয় না, তবু যাই। অনেক যাওয়াতেই মন সায় দেয়
না, তবুও যেতে হয়। ইদানিং অনেক কিছুই সহ্য হয় না।
মৃত্যু কিংবা মরা মানুষের মুখ। নিজেকে কেমন অসহায় লাগে। আমাদের যাওয়ার রাস্তাজুড়ে
থাকে তোমার উপস্থিতি। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও মানুষ অনিশ্চিত নিয়ে পড়ে থাকে। আমরা
অনিশ্চিতের দিকে যাত্রা করি। সে যাত্রা উত্তরে যায়, সোজা
উত্তরে। বগুড়া থেকে গাবতলি হয়ে সোনাতলা দিয়ে বোনারপাড়া অতিক্রম করে হরিপুর
গ্রামে যাই। যে গ্রামে এর আগে একবার মাত্র গিয়েছিলাম, তোমার
জন্মদিনে। ২য় বারের মতো যাত্রা। কী চমৎকার তোমার গ্রাম। কবিতার মতো সকাল হয়,
সন্ধ্যা নামে। পুরো গ্রাম জুড়ে কবিতার আবহ। সেটা কী তোমার জন্য
কবি? এ তল্লাটে তুমি না জন্মালে কি করে বিখ্যাত হতো
হরিপুর গ্রাম? যে গ্রামে এক কবির সৌজন্যে আগমন অনেক কবির।
কবি আক্তারুজ্জামান লেবুর জন্ম ১৯৯২ সালের ২৫ ডিসেম্বর। ততদিনে আমার ডিগ্রী পাশ
হয়ে গেছে। বয়সে কত ছোট! মৃত্যু ২০২১ সালের ২১ মার্চ। মাত্র ২৮ বছর। সংক্ষিপ্ত
জীবন কবির। এ বয়সে কেউ কি যায়, যায় না? আসলে থাকারও কি প্রয়োজন ছিল? ‘না জল না অনল’
কিংবা ‘দুষ্পাঠ্য দুটি চোখ’ কাব্যগ্রন্থ
লেখার পড়েও। ‘দুষ্পাঠ্য দুটি চোখ’ এর মতো কাব্যগ্রন্থ থাকলে বেঁচে থাকার আর প্রয়োজন পড়ে না। মানুষ
কতদিন বাঁচে, কবিতা বাঁচে তার চেয়েও বেশি। কবে
পরিচয়,
কীভাবে পরিচয়, আজ আর মনে নেই। কত ছেলেই
তো আসে যায় , কতজনকে মনে রাখা যায়? ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত বগুড়া লেখক চক্রে আমার আগমন সম্ভবত ১৯৮৯ সালে।
এই দীর্ঘ সময়ে কত ছেলে মেয়ে এসেছে গেছে, কত জনের নাম
মনে রাখতে পেরেছি। ছাত্রজীবনে শুরু করা সংগঠন এখন পরিপূর্ণ যুবক। ৩৩ বছর বয়স।
আমাদেরও ৫০ পেরিয়েছে। কিন্তু কবি আক্তারুজ্জামান লেবু মনে দাগ কেটে গেল। মাত্র
কয়েক বছরের পরিচয়, ঠিকভাবে ঘনিষ্ঠতাও হয়নি। সাফওয়া ,
হিরণ্য হারুন, সতেজ মাসুদ কিংবা হাদিউল
হৃদয়দের মত। সতেজ মাসুদ কিংবা হাদিউল হৃদয় নয়তো হিরণ্য হারুনের মাধ্যমেই বগুড়া
লেখক চক্রে এসেছিল লেবু। বগুড়া লেখক চক্রকে খুব ভালবাসতো , ভালবাসতে আমাকেও । কিন্তু অন্তর্মুখী কবি আক্তারুজ্জামান লেবু’র ভালবাসার প্রতিদান আমি দিতে পারিনি । ছেলেটা কেনো এত ভালবাসতো আমাকে,
কেনো এত শ্রদ্ধা করতো। কবিতার বই দেওয়ার সময় লিখেছে, ‘ভালবাসি খুব’। হিরণ্য হারুন কিংবা লেবুর
ছোটবোন আকলিমা যখন আমার প্রতি লেবুর ভালবাসার কথা বলে তখন বোবা হয়ে যাই । কাউকে
এত বেশি ভালবাসতে নেই রে বোকা। এত ভালবাসা যে এখন আমাকে কষ্ট দেয়, কাঁদায়। তোর কবরের পাশে যে দাঁড়াতে পারি না। কী করে এর প্রতিদান দেবো,
কী করে আর তোকে ভালবাসবো । এই ভালবাসা আমাকে সারাজীবন কুরে কুরে
খাবে। বগুড়া উডবার্ন পাবলিক লাইব্রেরি মিলনায়তনে কবিতাপাঠের অনুষ্ঠানে প্রথম
কবিতা পাঠ লেবুর। মঞ্চ থেকে নামার পর কে যেন পরিচয় করিয়ে দিলো। তারপরে ধীরে ধীরে
বগুড়া লেখক চক্রের একজন হয়ে যাওয়া । প্রায় অনুষ্ঠানে আসত , বিশেষ করে বড় অনুষ্ঠানগুলোতে ওকে পেতামই । ভাবতে
বসে একসময় দেখি, সংগঠনের এই সব ছেলে―
মেয়ে যারা বগুড়ায় লেখাপড়া করতে এসে কাছাকাছি চলে আসে, তারা শুধুই কী বগুড়া লেখক চক্রের সদস্য? তাহলে
এরা চলে গেলে কষ্ট পাই কেন? আহমেদ জুয়েল , ইন্দ্রজিৎ সরকার, মামুন রশীদ, বিধান সাহা, অচিন্ত্য চয়ন, সতেজ মাসুদ, হাদিউল হৃদয় কিংবা সাম্প্রতিক
সজীব মাহমুদ বগুড়া ছেড়ে চলে গেলে খুব কেঁদেছিলাম। সাফওয়ান আমিন কিংবা শৈবাল নূর
কিংবা হিরণ্য হারুন দু’একদিনের জন্যও বাড়িতে গেলেও মন
খারাপ হয় কেন? আসলে অন্যরকম সম্পর্ক নিয়ে সংগঠনের
পথচলা। প্রতিদিনই তো বকাঝকা করি, সমালোচনা করি তবুও
কামরুন নাহার কুহেলীরা ঢাকায় গেলে কিংবা আফসানা জাকিয়া দূরে থাকলে অভিমান হয়
কেন? এখনও কেনো বার বার মনে পড়ে তাকে? আমরা আসলে একটি পারিবারিক বন্ধন তৈরি করতে চেয়েছি, তা পেরেছিও। পেরেছি নিজেদের মধ্যে এক ধরনের বন্ধুতা বা বন্ধন যা
আমাদেরকে আঁকড়ে রাখে। কবি আক্তারুজ্জামান লেবুও তাই । লেবু’র জন্য যেমন কষ্ট , কষ্ট পাই হিরণ্য হারুন এর জন্যও। বন্ধুর জন্য সবকিছু করেছে সে। এরকম একজন কাছের বন্ধু চলে গেলে
সব কিছু শূন্য মনে হয়, শূন্য মনে হয়। হিরণ্য হারুন এর মতো বন্ধু পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার। কবি
আক্তারুজ্জামান লেবু’র দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘দুষ্পাঠ্য দুটি চোখ’ এক অনন্য অসাধারণ
কাব্যগ্রন্থ। কাব্যগুণে উত্তীর্ণ এই কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতায়, প্রতিটি লাইনে যে হাহাকার, যে যন্ত্রণা
পাঠকমাত্র তা অনুভব করতে পারেন । কাব্যগ্রন্থ জুড়ে পিতা, মাতা, বোন, প্রকৃতি,
মৃত্যু ছড়িয়ে আছে । এত যন্ত্রণা সহ্য করে কী করে এত চমৎকার
কবিতা লেখা যায়? জীবন বিকশিত হবার আগেই, স্বপ্ন পূরণ হওয়ার আগেই, মাতা-ভগ্নীকে
প্রাপ্য সম্মান দেয়ার আগেই কেউ যেতে চায় না, তুমিও
নিশ্চয়ই চাওনি কবি। কিন্তু অলঙ্ঘনীয় এক বিধান তোমাকে নিয়ে গেল ছিনতাই করে। কী
চমৎকারভাবে কবি শুয়ে আছেন । বাড়ির ঠিক পশ্চিমপার্শ্বে নিজের তৈরি করা উঁচু
ঢিবিতে,
কদম গাছের তলে, বাবার পাশে। যে বাবা
তোমার যাবার দু’বছর আগে চলে গেছে তোমার মায়ের চোখে এক
সমুদ্র জল রেখে। কী রকম সবুজে ভরে আছে মাঠ, তার মাঝখানে
তোমার থাকার ঘর, যদিও মাটির, চারধারে
গাছ। এই গরমে ধানখেতের দোল খেতে তোমাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে যে বাতাস, সেই বাতাস তোমাকেও কী আন্দোলিত করে কিংবা আলোড়িত? তোমাকে কবিতা লেখার স্বপ্ন দেখায় কিংবা প্রেম করার? এগুলো তো জাগতিক বিষয়। তুমি এগুলোর বাইরে আল্লাহর মেহমান। তুমি শুধু
জানবে না, আজ থেকে আরো ১০ বছর পরে তোমার ছোট বোন আকলিমা
দুটি সন্তানের মা হবে, তোমার বন্ধু হিরণ্য হারুন বিয়ে
করে নতুন সংসার পাতবে আর এক অধম সংগঠক ইসলাম রফিক বয়সের ভারে ন্যুজো হতে হতে
ছানিপরা চোখে তোমাদের স্মৃতি হাতড়ে দুচোখে বেয়ে নেমে আসা জল মুছবে।
0 মন্তব্যসমূহ