কবির
বিশুদ্ধ গহনরাজ্য থেকে অশুভ সংঘাতে দীর্ণ জাগতিক বিশ্বের দূরত্ব কতটুকু? একজন কবি এই দুই বিরোধী প্রান্তরের ভেতর বিচরণ করেন কী করে? কবি আক্তারুজ্জামান লেবু তার কবিতা দিয়ে আমাদের দেখিয়েছেন এ দূরত্ব
অত্যল্প। কবিতায় তার স্নিগ্ধযাত্রা আমাকে ভীষণভাবে বিহ্বল করেছিল, করছে এবং করবে। মনে হয়, কবিতা তার মগজে আসতো
চুপিসারে। জানি, সোনার খনির পথ কোনো মানচিত্রেই স্পষ্ট
থাকে না। ভ্রান্তিতে গোপন করা সে পথ, তুফানে চিনেও যথাযথ
এগোবার ঠিক ভরসা পাই না আমরা। অথচ আক্তারুজ্জামান লেবু ছারখার করে দেওয়া রোগে,
শীর্ণ শরীর নিয়েও কাঁপা কাঁপা পায়ে এগিয়ে যাবার স্পর্ধা দেখিয়েছে। কুর্ণিশ না করে উপায় থাকে না
আমাদের। লেবু জানতো তার এই চাওয়াটা, জগতের এক কোণ থেকে আর
এক কোণে যায়। ধাক্কা, ঘুরপাক আর ডিগবাজি খেয়ে হয়তো ছিটকে
পড়ে নিজেরই অজান্তে তার চেনা ক্যানভাসের বাইরে। দোয়াতের জলে, চোখের কালিতে তারা ফ্যাকাশে হয়। বৃষ্টি যতই হোক তবু রোদ ওঠে বর্ষাতে।
আহারযোগ্য করে লেবু তার কবিতার কাঁটাগুলো, বিষগুলো ছেঁকে এনে আমাদের পাতে তুলে দিয়েছে। আক্তারুজ্জামান লেবু’র
কবিতায় ধ্বনি ও বর্ণের অন্তহীন ঐকতান এতটাই জোরালো, মানবের
মৃত্যুকেও বুঝি তা রোধ করে। মৃত্যুকে বাম হাতে বেঁধে রেখে ডান হাতে শুধু কবিতার
অন্ধিসন্ধির তালাশ করতে চেয়েছিল সে― সবরমতি সন্তের মতো। শরীর ভগ্ন হলেও সমস্ত মন জুড়ে জ্বলজ্বল করতো লাল
অক্ষরের এক ও একান্ত শব্দ― ‘ভালোবাসা’।
জানি, চূড়ান্ত সংকটের মুহূর্তেও জেগে থাকে আমাদের আস্থার পর্বগুলো। এই এত এত
অর্থ, বন্ধু-পরিজন, স্বয়ং ঈশ্বর― সব যখন ব্যর্থ হয়, তখন মানুষ কোথা থেকে শক্তি
পায়? জীবন নামক হটকারী বিশৃঙ্খল স্রোত-প্রতিস্রোতে কে
জোগায় বাঁচার মন্ত্র? আমাদের
অনুভূতিময় জীবনভাষার ভেতর, জল স্থল আকাশ থেকে মহাকাশ
প্রতিটা অনিবার্য থাকার ভেতর, আমরা খুঁজে ফিরি একটি শব্দ, একটি বাক্য যা সময়কে লেহন
করে গুপ্ত পরম্পরায় দর্শনের দরদ দিয়ে, সকল প্রসন্নতা নিয়ে
শরীর তথা মস্তিষ্কের সীমানাকে টপকে তিল তিল করে জমা হয় কবিতার ওয়্যারহাউসে। একজন
কবি যিনি আক্ষরিক অর্থেই তার সন্ধান পান হয়ে ওঠেন তার সংগ্রাহক, তখনই মায়াবী মুক্তির পথ তার সামনে এসে হাজির হয়।
কবি
আক্তারুজ্জামান লেবু ছিল তেমনই এক গণ্যজন। কবিতার গোত্রবন্ধু। সকল সরলতায় হে আমার
ছোট ভাই,
তোমাকে আমি স্নেহের চুম্বনে চূড়ার শীর্ষে রেখে দিতে চাই।
আক্তারুজ্জামান লেবু, যিনি নিরঞ্জন পৃথিবী থেকে, মুকুলের গন্ধ থেকে, হাঁসের পালক থেকে ছিটকে
যাওয়া রোদেলা রাংতাটুকু ব্রহ্মচারীর মতো খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্তিতে ক্লিষ্ট হয়েছেন। আমি দেখেছি হাজারও শূন্যতার মধ্যে
বিবিধ বিষণ্নতায় তাকে ডুবে থাকতে। ভীষণ খুঁতখুঁতে ছেলে। উচ্চাঙ্গের উৎকণ্ঠা, ব্যক্তিত্বের
সরল ঋজুরেখা থেকে দৃষ্টি ফেরালে মনে হবে, লেবু যেন
সমুদ্রে ভেসে থাকা বিরাট আর নির্জন এক মাস্তুল। লেবু হল সত্যিকারের সেই অকিঞ্চন
পিঁপড়ে, যে ক্ষুদ্র আধার হয়েও জমাট মধুর স্ফটিক কণা খুঁজে খুঁজে খুটে আনার চেষ্টা করেছিল।
যে
নিসর্গকে সঙ্গী করে আমার-আপনার বেড়ে ওঠা, লেবুকে
দেখেছি আমি তারও একটা রৈখিক পদ্ধতি ছিল। নিজস্ব ছকে ছাদিত হয়ে মৌন যুক্তিকাঠামোর
মধ্যে গেঁথে থাকতে চাইতো সে। রোগের রোশনাই যতই বেড়েছে তার চিন্তাতন্ত্র ততই হা হা
করে হেসে উঠেছে। বুঝি না এ সাহস কোথা থেকে পেতো! লেবু তো পাথর ছিল না, নিসর্গ প্রকৃতি থেকেই উঠে আসা রক্ত-মাংসের মানুষ। হ্যাঁ, সামান্য ২৭ বছর বয়সেই তার অভিজ্ঞতার বৈভিন্নতা অন্য অনেকের থেকে
প্রাজ্ঞতা দিয়েছিল তাকে। এ যাবৎ যা-কিছু লিখেছে লেবু, তা
যে বাংলাকবিতার য়্যাবস্যলুট সম্পদ, সে ব্যাখ্যায় যাব না
আমি। তবে নবাঞ্চলের স্বাদে তা কিছুটা হলেও বায়ুজলরোদবৃষ্টির মতো ডিভাইন। তবে অতি
অভিজ্ঞতারও একটা অশোভন দিক আছে। যা অতিপ্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির কথা সহজেই বলতে পারে।
লেবু’র বিষণ্ন প্লাবিত ভাবনা, উদাসী যন্ত্রণা, সতোৎসার বিশ্বাস, সাহসী বিচিত্রমুখিনতা,
বাহারি বোধ, আত্মার কাতরতা আজ ঢেঁকুর
তোলা প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তার
বিচিত্র কামনা ও সৃষ্টির আগুনে প্রোজ্জ্বলিত অগ্নি অহেতুক দাউদাউ করে জ্বলতে
জ্বলতে আলাভোলা অঙ্গারে পরিণত হয়। শীতল হয়ে এলে যেখানে শুধুই পড়ে থাকে ছাই। আর ঠিক
তখনই মরমীয়া সূর্য অস্ত যায়। কাজলের কালি হয়ে লেপ্টে থাকে সন্ধেছায়াময়। এরপর উঁকি
দেয় রাত। রূপ ডাইভার্ট হয়ে পরিণত হয় অরূপে। মহাবিশ্বের গর্ভগৃহে ঢুকে তলিয়ে যেতে
যেতে চিৎকার করে লেবু বলে― আমাকে পথ
দেখাও। কবরে আমার বিশুদ্ধ একটি কবিতার বীজ পুঁতে দিতে
চাই। ফুল নয়, ফল নয়, হে মরণ!
কবিতাবৃক্ষের ছায়ে আমি আবৃত থাকতে চাই। আহা! একজন অসহায় মানুষ, এর চাইতে আর কতটুকুই বা চাইতে পারতো?
দীর্ঘ
দেড় বছর ধরে লেবু তার মৃত্যুকে ঠেকাতে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াই করে গেছে।
হাসিমুখে হতাশার কথা বলতে, শুনতে সে নারাজ ছিল। যদিও
জীবন আসলে চক্র। এই চক্রের আধারেই মানুষ এবং তার পরিবেশ বিরাজ করে। তার বৃত্তাকারে
পূর্ণযতির দিকে এগিয়ে চলা ফুরোয় না কখনো। হয়তো এ কথা লেবুও জানতো, মানতো। সহজ সুখের চেয়ে অসুখ বেছে নিয়ে তাকে অন্য পরিভাষায় একই সাথে
প্রতিবাদ ও সুখকর করে তোলা মোটেই সহজ কাজ না― স্থলনের টানটান সম্ভাবনা থাকে তাতে। লেবু সম্ভাবনার এই বিপজ্জনক সরু
সুতোর ওপর দিয়ে এগিয়েছে প্রতিনিয়ত।
হাট
শেষে হাটুরেরা ফিরে যায় যে যার গন্তব্যে। নিভে যায় সমস্ত কুপি ও চেরাগ। অন্ধকারে
পড়ে থাকে কানার, শূন্যের হাট-বাজার। এত যে প্রাণ,
এত কোলাহল, এত লেনদেন, এত নগদ, এত বাকি। অথচ হুট করে নেমে আসা অসীম
এক নিঃস্তব্ধতায় লেবু― আমি তোমার
সাহিত্যের ভাঙা হাটে দাঁড়িয়ে আছি একা। তোমার সঙ্গে আমার
সমস্ত সংযোগ, সম্পর্কের স্মৃতিগুলো হাতড়ে হাতড়ে কেনো তবে
একত্রিত করতে চাইছি? ওই যে তোমার কবিতার ন্যারেটিভ,
ওই পাশে পড়ে আছে উপমা, উৎপ্রেক্ষা। একটু
দূরেই ছন্দগুলো ভাঁটফুলের মতো গন্ধ ছড়াচ্ছে। মার্চের মাঝ
রাতে শিশিরে ভিজে যাচ্ছে তোমার ‘না জল না অনল’। তোমার ‘দুষ্পাঠ্য দুটি চোখ’
অতীন্দ্রিয় ঋতুচক্রের ভেতর লুকিয়ে পড়ছে ধীরে ধীরে। কাকে ছেড়ে কাকে আমি বাঁচাব বলো?
ছিমছাম, কোলাহল থেকে খানিকটা দূরে থাকা সদা হাস্যোজ্জ্বল এই তরুণ, চিরকালই ছিল কবিতার সৌন্দর্যের পথে। এড়িয়ে চলতো ঝুটঝামেলা। বছর দেড়েক
আগে শরীরে তার বাসা বাঁধে কর্কট রোগ। ডাক্তার আর পথ্যে
জীবন হয়ে আসে নিয়মে-বাঁধা, শৃঙ্খলিত।
ফলে কিছুটা সংযোগ― হোক তা
কথায় বা দেখায় হয়ে এসেছিল স্তিমিত। তবে ওই যে কথায় বলে, কবিতা― একবার যার রক্তে ঢুকেছে সে যাবে বারবার তাকে ধরতে। মরীচিকার মতো মনে
হবে। কী যেন চিকচিক করছে। আর একটু যাই, হয়তো পাওয়া যাবে।
আর এই টানেই আমৃত্যু কবিতার গন্ধেই মশগুল ছিল লেবু। আমি বলতাম, এ হল কবিতার বিষ! একে টেনে, শুষে নেবার জন্য
একমাত্র কবিতাই পারে বিষপাথরের মতো কাজ করতে।
অনেক
ঘুরেছি আমরা। মিশেছি অনেক। লেবুকে দেখেছি কখনো বন্ধু কখনো স্নেহের ছোট ভাই রূপে।
হাজারো ভালোলাগা আজ এই দুঃখের দুর্বিসহ রাতে বন্দি হয়ে থাক, না-খোলার সিলমোহরে। কবিতার বীজ নিয়ে বিভাজন হবে, বিগত আড্ডার ওপরে আছড়ে পড়বে নতুন আড্ডা। এই বসন্ত ঝরে পড়বে আর এক
বসন্তের গায়ে। চাঁদ উঠবে চাঁদের
মতো করে। শুধু তোমাকে পাব না আমি। পাব না আমরা। মৃত্যুকে পেরিয়ে নতুন জগতে তোমার এ
যাত্রা হোক কাব্যময়। ভালো থাকাটাই বড় কথা নয়। ভালোবাসা! সে কি সবার কপালে জোটে?
প্রকৃতির
সকরুণ ছেলেখেলায় মাত্র ২৭ বছর বয়সে চলে গেল লেবু। বিদ্রুপে বিধ্বস্ত করে গেল
আমাদের। তবু তার সাহস দেখে, অনন্তের কণ্ঠস্বর কবিতার
ঢেউ হয়ে আছড়ে পড়া দেখে, আমি তাজ্জব বনে যাই। যেতে হয়। তার
হৃদয়-নিংড়ানো কথাগুলো, ভাবনাগুলো লাফিয়ে উঠছে দ্রুত।
ফসফরাসের মতো সাদা আর নীল দাঁত দিয়ে ছোবল মারছে নৈঃশব্দের
গায়ে। লেবু ছিল সার্কাসের সেই বাঘ যে কিনা জীবন মুত্যুকে মুঠোয় বন্দি করে অবলীলায়
লাফ দিতে পারে দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা আগুনের রিঙে!
অনাথ বালকের মতো লেবু
যেন মাথা তুলে বলছে― আমাকে
পড়ো। সেইহেতু আমিও বলি― ওগো আয়েসী বিলাসিনী, তুমি কী পড়বে না, ধরবে না তুলে তার কবিতার কণা
তোমার দেহশীর্ষে? চলছে মসৃণ বোকা বসন্তের দিন। চুপিসারে
রাতে নামবে খানিকটা হিম! পাতার আড়াল থেকে উড়াল দেবে পেঁচা। ব্যথার যন্ত্রণায় ঘুম
ভেঙে কুঁকড়ে যাওয়া মুখে জোড়ালো হাসির হসন্ত ফুটিয়ে তুলে লেবু আর বলবে না― কষ্ট
কই? কষ্ট বড়ো খারাপ জিনিস। ভালো আছি ভাই, কবি আক্তারুজ্জামান লেবু তোমার কবিতার কসম খেয়ে তবুও বলি― ‘আমি
হয়তো থাকব না, তবু তোর পায়ের সামনে থেকে যাবে অনন্ত সড়ক― সাবধানে
যাস।’
0 মন্তব্যসমূহ