বাংলা সাহিত্যের দু’ফোঁটা
হোমিওপ্যাথিক ✺ হিরণ্য হারুন
১. যাপনের
চালচিত্রে ‘না জল
না অনল’ কবিতার
সাইক্লয়েড
যাপনে দুঃখ, দুঃখে যাপিত জীবন—
মানুষের যাপনে মানবতা। মস্তিষ্ক ভেঙে ভেঙে নিউরন জাগরণে কবিতা হয়ে ওঠে যাপিত
সুখ-দুঃখ-বেদনা। এভাবে কবি আক্তারুজ্জামান লেবু'র কবিতা হয়ে ওঠে ‘না জল না অনল’!
কবিতা কেমন, কেন তার বিষণ্নতাবোধ, কেমন তার যাপন— কীভাবে কাটে তার সুখ-দুঃখের ঘর, বাবা-মার সাথে বসতি, প্রেমের
ঘরে লেনদেন। ‘না জল
না অনল’ কবিতাগ্রন্থ
জুড়ে জীবনের ছবি, মৃত্যুর রঙ। প্রেমকে
এখানে তুলে আনা হয়েছে ‘উদারতা’য়—ভঙ্গিমায় নারীর বুকে জুড়ে বেদনানাশক পৃথিবীতে। চলতি পথে
গল্পগাঁথা—জীবন ও কষ্ট যেন নকশীকাঁথার সেলাইয়ে গাঁথা। কবি তার যাপন সিরিজ কবিতায়
বারবার আঘাত করেছেন হেমন্তের সকাল, বিকাল অথবা সন্ধ্যায় মানুষের জীবনে যাপন। যাপনের
অবকাশে তিনি হেমন্তের কবি, ক্ষতচিহ্নে জীবনের বাহক।
তারপর যাপনের তীরচিহ্নে তিনি খুঁজেছেন প্রিয় কারো চিঠি— ব্যর্থতার সোপান বয়ে
গেয়েছেন জীবনের গান—
‘আমাকে ব্যবচ্ছেদ করে
মহাকাল কীভাবে পোর্ট্রেট আঁকে দেখে যাও’
অপেক্ষার
সমাচার আর সুখের নীল বেদনায় কবি যে পোর্ট্রেট রেখেছেন তার ব্যবচ্ছেদ হয় সময়ে, মহাকালে—
‘প্রকৃতির হোয়াইট বোর্ডে চেয়ে
চেয়ে
তাদের শিখে নিতে হয়—
হানিমুনের অপেক্ষা
আর
মৃত্যুর অপেক্ষার ডিজাইনেশনটা এক নয়।’
মানুষের চরিত্র, স্বভাব সময়ের ঋতুকালের মত
বৈচিত্র্য। কবিতার চিত্রে তা আরো গাণিতিক, হয়ত
একটু বেশি নিষ্ঠুর—
‘মানুষ তো চিনবেনই
তখনই চিনবেন
যখন চিনে আর আপনার কোন কাজ নেই।’
পাথর
গলে গলে, বৃষ্টি ঝরে ঝরে— লেখা
কবিতায় ওঠে এসেছে কবি'র
ব্যক্তিগত জীবন ও যাপন। মায়ের টান আর বাবার গল্প কবিতায় পড়েছে ছাপ—
‘আমার মায়ের গোসলই হবে না তখনো
তার দৃষ্টির সীমানায় তৃষ্ণার জল উঁকি দিয়ে যাবে
ভেতরে সমুদ্র রেখে পুড়ে যাবে চোখ
পুড়ে যাবে চোখ....’
কবিতা
ইউটার্ন নিয়েছে—রিহার্সেল করেছে— কবি’র ব্যক্তিগত যাপনে, গোপন প্রজ্ঞাপনে রুল জারি
হয়েছে— ‘না জল
না অনল’ কবিতাগ্রন্থে।
‘মৃত্যুকে সামনে দাঁড়িয়ে রেখে
আমাকে পুড়িয়ে ভাসায়, না ভাসিয়ে পোড়ায়
না জল, না অনল’
ব্যক্তিগত অনুভূতির মার্জিনে কবিতাগ্রন্থটি শূন্যতাকে যাপিত করেছে
অশূন্যক মহাবিশ্বের সাইক্লয়েড।
২. ‘দুষ্পাঠ্য
দুটি চোখ’ কবিতাগ্রন্থটি বাস্তব ও পরাবাস্তব জীবনের প্রতিফলন
সময়ের শিলালিপিতে আমাদের জীবন যাপিত হয়, কবিতা লিপিবদ্ধ হয়। সময়ের যাত্রায় আমরা অতীতে যাই
স্মৃতি হয়ে, ভবিষ্যৎ দেখতে পাই আলোক
পথে। কবি
সময়ের বাহক, কবিতার প্রফেট। যাপিত
জীবন, জারিত মগজে কবিতা আমাদের
ধারণ করে তার চরণে চরণে, শব্দে শব্দে, অক্ষর ভেঙে ভেঙে। কবি আক্তারুজ্জামান লেবু’র কবিতাগ্রন্থ ‘দুষ্পাঠ্য
দুটি চোখ’ বাস্তব ও পরাবাস্তব জীবনের প্রতিফলন।
‘একটি দীর্ঘশ্বাসের চিঠি
পাঠালাম/
অবসরে পড়িও/
আমার ঠিকানাটা কাঁচের মতো/
সাবধানে ধরিও।’
কবিতার এই পঙক্তিগুলো বিশ্লেষণ করা দুরূহ ব্যাপার কিন্তু তা অনুভূতিময়, এ-যেন আমাদের কথা বলছে, এ-যেন আমার, আপনার
জীবন, সময়ের প্রেমময় ঋজু পথ অথচ
উঁচুনীচু। কবি
আক্তারুজ্জামান লেবু’র কবিতায় বারংবার তার ব্যক্তিগত জীবনের প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায়।
কবিতাগুলো যখন আমরা পাঠ করি তখন তা হয়ে যায় আমাদের ব্যক্তিগত— আমাদের ব্যক্তিগত বিষণ্নতাবোধ, ভালোবাসা, হাসি, কান্না, বিরহ।
‘যতই আঘাত করো /
ততই ভালোবসতে ইচ্ছে হয়/
আমার ইচ্ছেগুলো এমনি যাতনাময়।’
এই পঙ্ক্তি যেন সেই চিরচেনা আমাদের কথা, রবি ঠাকুরের কথা “সখী, ভালোবাসা কারে কয়! সে কি কেবলই যাতনাময়।”
‘দুষ্পাঠ্য
দুটি চোখ’ কার চোখ! আমার, আপনার, নাকি সমাজের? একজন বাবার—
‘বাবাকে বেচে খেয়েছি অনেক দিন,/
তার দুষ্পাঠ্য দুটি চোখ আর অসহায় দুপুরগুলোকে /
আমি আর কারো কাছে বেচবো না ভেবে চুপ করে থাকি।’
একজন মায়ের—
‘মা, আমার সামনে তোমার চোখদুটো
কি গোপন করা যায় না?/
আমার কাছে ওই চোখদুটো যে তোমার বেদনা দেখার আয়না।’
কবিতাগ্রন্থটি উপমায় ভরপুর। কবি তার জীবনবোধকে দেখেছেন সন্ধ্যায়, হেমন্তের ধূসর মাঠে অথবা—
‘বাবার চোখ/
সন্ধ্যার ব্যবচ্ছেদ ডেকে আনে’
কবিতা
কী? সময়ের আপেক্ষিকতায়
ব্যক্তিগত অনুভূতি নাকি সময়কে বিক্রি করে ব্যক্তিকে উপমায় বেঁধে অলংকারে সজ্জিত করে
সার্বজনীন সর্বোৎকৃষ্ট দর্শন।
‘তবু কারো কারো সন্ধ্যাজুড়ে
বৃষ্টি হলে /
চিরতরে চলে যাবার সময় হয়ে আসে।’
হেমন্ত আসে।
‘তবু আমার শেষ পত্র হেমন্তের
কাছেই রেখে যাবো। /
লিখে যাবো না পাওয়ার বিশুদ্ধ ব্যাকরণ,/
অনন্তের স্তবক।’
কোনদিকে
হাঁটো তুমি পথিক, কোন পথে লেখো কবিতা। কি
চাও এই জীবনে শেষ সময়ে, আপনি কি প্রেমিক ওহে কবি—
‘নারী, শুনেছি তুমি ট্রেনকে পরাজিত করতে
পারো/
কোকিলের সুর ধরে এ-কথা বলে যায় প্রেমিক হৃদয়।’
এই কবিতাগ্রন্থটি প্রচলিত অঙ্কের হিসাবে ছন্দে খেলানো না কিন্তু পাঠক
কোথাও ধ্বনি বিপর্যয়ে পড়বে না, ধ্বনিত প্রবাহ তাকে একটা
ছন্দ দিবে হয়ত প্রচলিত ভাষায় আমরা বলে থাকি গদ্যছন্দ। কবিতাগ্রন্থটির আরো একটি বড়
গুণ এখানে দুর্বধ্যতা নেই, অন্তঃস্থভাবে একটি সরল
অর্থদ্যোতকতা তৈরি করেছে। যদিও তা অত সরল না। কেউ যদি মনে করেন পাঠ করা মাত্রই
কবিতার স্পর্শের অনুভূতি পেতে হবে, সেক্ষেত্রে
কবি স্পর্শ জাগাতে পেরেছেন আমাদের হৃদয়ে।
0 মন্তব্যসমূহ