সাম্প্রতিক প্রকাশিত

10/recent/ticker-posts

কবি শাহাদত হোসেন —এর কবিতা ও কবিতা ভাবনা

শাহাদত হোসেন


আয়ু

বনের পাতাগুলো মর্মর ধ্বনিতে শিমুল তুলোর মতো উড়ে গেলে কালো নিঃশ্বাস তির্যকপাতনে ধেয়ে আসে আমার বুকের উপর। আমি তখন ক্লান্ত হই, ক্লান্ত নগ্ন পায়ে পথ ধরি বনের দিকে যেখানে আর্তনাদ করে ডাকছে মা হারা একজোড়া সদ্যোজাত শাবক। কুকুরগুলো  ডাকছে নিশীথি অন্ধকারে। অলক্ষুণে বাতাস দরজার দিকে অবিরত তাকিয়ে আছে রঙচটা ফড়িংয়ের মতো। আমি আর সে পরস্পরকে দেখছি যুগান্তকারী চোখের মধ্যভাগে। অতিবাহিত সময় যেন জীবনের মতোই প্রবহমান। নষ্ট ঘড়িও হয়তো সঠিক সময় দেখায় কিন্তু অতিক্রান্ত সময় শালিক পাখির মতো আর ফিরে আসে না নীড়ে।
 
তাই ধাতব শরীরে ক্ষ্যাপাটে হাতুড়ি বারবার আঘাত করে সময়ের আদি প্রান্তে...
 
 
পাতার শেষ নৃত্য

চোখে মুখে নগ্ন উচ্ছ্বাস যেন বহুদিনের জমে থাকা গাঢ় ক্লান্তি আধমরা পাতার মতো ধীরে ধীরে উল্টে যাচ্ছে। সময় হেলেছে চূড়ান্ত পতনের দিকে। বিক্ষুব্ধ বাতাসের আহ্বানে সে দুলছে, মায়ের কোলে গিয়ে আশ্রয় নেবে বলে।
 
পৃথিবী যেন স্থির অথচ চলমান। আকাশের রং ম্লান হয়ে গেছে। শেষ পাতাটি ধীরে ধীরে নিঃশেষিত হয়ে যায় যেমন নিঃশেষিত হয় প্রতিদিনের ক্লান্ত আলো।
 
 
নিষ্ক্রিয়তা

শরীর জুড়ে বরফের মতো ঠান্ডা একাকিত্ব
ঝরে পড়া বৃষ্টির মতো ক্লান্ত আমি
শীর্ণ ফুসফুস মেলে শুয়ে আছি
মৃত্যু পালকের বিছানায়।
 
তুমি এসেছিলে নীরবে, মরীচিকার মতো
বালির মতো ছড়িয়ে দিয়ে গেলে আমাকে
আমি শুকনো পাতার মতো ঝরে পড়েছি,
পড়ে আছি চিৎ হয়েই
শীতল নিস্তব্ধতায়।
 
তবু বেঁচে আছি বালির ভেলায়
যে ভেলা ঢেউয়ের সাথে মিশে গেছে চিরতরে।
 
 
অন্তিম

কখনও কি শুনেছো মৃত্যুর কণ্ঠস্বর?
কী শব্দহীন ছুঁয়ে যায় আমাকে কোমল পালকে!
 
আমার বুকের ভেতর কে যেন বাজায় নিনাদের সুর
বিষণ্ন বাঁশির সুরে মুছে যায় সময়ের দূরত্ব।
 
নিভু-নিভু প্রদীপের শিখায় ফুটে ওঠে আলো
হয়তো তার সাথে এ আমার শেষ দেখা
অদ্ভুত নীলিমায় মিশে যায় মেঘের ধূসর রেখা
 
নিঃশ্বাসে মিশে যাচ্ছে নদীর ঠান্ডা জল
আমার চোখে সবুজ ঘাসের শেষ ছোঁয়া।
 
তোমরা আর কাঁদো না প্রিয়জনেরা
আমি আছি এই বৃষ্টিধোয়া বিকেলের ভেতর।
 
 
অজানা

পরস্পরকে চিনি না। তবু প্রাগৈতিহাসিকের মতো তোমাকে আগলে রাখি সবসময়ের তলপেটে। চেনা-অচেনায় ক্ষণজন্মা আয়ুকে হাতে রেখে নভোচারীর মতো মহাকাশ যাত্রায় নিজেকে বিলিয়ে দেই শূন্যগর্ভায়। আর আমার হাত দুটো শূন্য মধ্যাকর্ষণের চাপে উড়ে উড়ে খোঁজে আরও একটি উড্ডীয়মান হাতকে।
 
আমি এখন মহাশূন্য পরিভ্রমণকারী। আলো-আঁধারি বিল্ডিং, শৃঙ্খল ইট-পাথর, উঁচু উঁচু ইমারত সবকিছু বিলীন হয়েছে যেভাবে বিলীন হয় মৃত মানুষ তার পাওনাদারদের থেকে।
 
চোখের কোঠরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির শব্দ। অলিখিত শব্দগুলো বহুদিন থেকে অভিমান চেপে শৃঙ্খল যাপন থেকে মুক্তি চেয়েছিলো বহুবার। তারপর থেকে বাস্তুসংস্থানের সূত্র ধরে সর্বনিম্নে অবস্থান করছি।
 
 
শাহাদত হোসেন এর কবিতা ভাবনা

কবিতা নিয়ে আমার ভাবনা একটি গভীর, অন্তর্নিহিত অভিজ্ঞতা। কবিতা এক ধরনের শিল্প যা শব্দের মাঝে নিজের অস্তিত্বের প্রকাশ ঘটায়। এক একটি শব্দ, এক একটি বাক্য এক ধরনের শৈল্পিক ভাষা বহন করে, যা মানব মনের সব গোপন অনুভূতির দরজা খুলে দেয়। কবিতার প্রতিটি পঙ্ক্তি জীবনের গভীরতর স্তরের প্রতিধ্বনি, যেখানে আমাদের সুখ, দুঃখ, ভালোবাসা, বেদনাসব অনুভূতি একাকার হয়ে প্রবাহিত হয়।
কবিতা কেবল কিছু শব্দের বিন্যাস নয়, বরং তা এক ধরনের আবেগের বহিঃপ্রকাশ। এটি এক ধরনের যাদু, যা এক মুহূর্তে মানুষকে বাস্তব থেকে আলাদা করে নিয়ে যায় আরেক জগতে, যেখানে অনুভূতি ও কল্পনার মুক্ত স্বাধীনতা আছে। কবিতা আমার কাছে একটি অন্তর্দর্শনের মতো, যেখানে আমি নিজের সঙ্গে এক ধরনের সংলাপে লিপ্ত হই। প্রতিটি শব্দ যেন আমার মনের ভেতরকার ভাবনাগুলোকে বুনে চলে।
একেকজন কবির অনুভূতি প্রকাশের নিজস্ব কৌশল, নিজস্ব স্বর থাকে। কোনো কবি হয়তো প্রকৃতির অনন্য সৌন্দর্য তুলে ধরেন, আর কেউ হয়তো মানুষের অস্তিত্বের টানাপোড়েনের গভীরতা তুলে ধরেন। এই ভিন্নতার মাঝেই কবিতার মহিমা; কারণ তা প্রতিটি হৃদয়কে আলাদা করে ছুঁয়ে যায়। আমার কাছে কবিতার সবচেয়ে প্রিয় দিক হলো এর বহুমাত্রিকতা। এটি একাধারে একটি ভাষার শৈল্পিক প্রকাশ এবং একইসঙ্গে এক ধরনের মুক্তি, যেখানে মানুষ নিজেকে তার পুরো অস্তিত্ব দিয়ে প্রকাশ করতে পারে। প্রত্যেকটি কবিতার প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি ছন্দ যেন আমার মনে নতুন চিন্তার সঞ্চার করে, আমাকে অনুপ্রেরণা দেয় নতুন কিছু ভাবতে, নতুন কিছু অনুভব করতে।
কবিতার এক অন্যরকম সৌন্দর্য রয়েছে, যে সৌন্দর্য ধরা যায় না, শুধুমাত্র অনুভব করা যায়। এটি এক ধরনের প্রতিফলন, যা আমাদের মনের আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ