সাম্প্রতিক প্রকাশিত

10/recent/ticker-posts

তানভীর হোসেন ―এর ‘গল্প’

তানভীর হোসেন

গল্প  

 
১.
ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় প্রতিদিন সকালে কফি আর বিড়ি নিয়া বসে পলাশ। মোবাইল ফোনে ইউটিউব দেখে। প্রতিদিন সকালেই একটা বিষয় ভেবে খুব শান্তি লাগে ওর। সেইটা হইল অন্তত গ্রেগর সামসার মত হুট করে কিম্ভূত কোন কীটে পরিণত হয় নাই। কাফকার সবচাইতে ফালতু কাজ মনে হয় মেটামরফোসিস!
 
ইউটিউবে ব্রিটিশ একজন টিভি উপস্থাপিকারে দেখা যাইতেছে। কি জানি কি ফ্রাসোয়া! বেশ সুন্দরী। গলায় বেশ ঝাঁঝ নিয়া সে ইসরায়েলি আর্মিদের কুকীর্তির বর্ণনা দিচ্ছে। সামনে সম্ভবত ইসরায়েলি কোনো লোক বসা। সম্ভবত কোন ইন্টারভিউটিউয়ের একটা অংশ নিয়া বানান হইছে রিলটা।
 
একটা সরকারি অফিসের দ্বিতীয় শ্রেণির চাকুরে পলাশ। সারাদিন খালি হিসাব আর হিসাব। অফিসে ওর বসার জাগাটার ঠিক সামনেই একটা বিরাট সাইজের জানালা। সেইটা দিয়ে বাইরে তাকাইলেই একটা জলপাই গাছ। বিষয়টা যেদিন ও প্রথম খেয়াল করে সেদিন বেশ অবাক হইছিল মনে পড়ে ওর। কারণ এইরকম বিষয়-আশয় ও ভাবত খালি গল্প-উপন্যাসেই হয়। মানে সাধারণত জানালার বাইরে আর যাই হোক লোকে জলপাই গাছ থাকবে আশা করে না। তাও আবার সরকারি অফিসে। কিন্তু ওর ক্ষেত্রে সেটা হইছে। জলপাই গাছটা অনেক বড়। এত বড় জলপাই গাছ পলাশ জীবনে এর আগে কখনও দেখে নাই। কিন্তু সমস্যা হইল এত বড় একটা গাছে পাখি বলতে আছে শুধু একটা কিম্ভূত কাক। তাও আবার দাঁড়কাক। শক্তপোক্ত একটা ডালে বাসা কইরা থাকে সে। গত ১০ বছরে পলাশ আর কোন পাখি সেখানে দেখে নাই। মনে হয় কাকটার দাপটে আর কোনো পাখি সেখানে বাসা বানাইতে সাহস পায় না। এই কাক বিষয়ক ভাবনা থেকেই একদিন পলাশ বুঝতে পারছিল যে, সে পাখি জেন্ডার বুঝতে পারে না। তার কোনো প্রয়োজনও অবশ্য নাই!
 
পলাশের কফি খাওয়ার অভ্যাস হয় তার এক প্রাক্তন বসের কারণে। অভ্যাসটা ব্যয়বহুল। সাধারণত তার লেভেলের আর কোন চাকরিজীবিরে সে এত কফি খাইতে দেখে নাই। মাঝেমাঝে ওর মনে হয়, শুধু কফির খরচ তুলতেই টুকটাক ঘুষ খায় সে। দ্বিতীয় শ্রেণির চাকুরে হলেও ঢাকা শহরের বেশ ভাল একটা আবাসিক এলাকার একটা সাততলা বিল্ডিংয়ের লিফটের ৩ তলার ২১০০ স্কয়ার ফিটের একটা অ্যাপার্টমেন্টে বউ আর একমাত্র কন্যা নিয়া থাকে সে। খরচ অনেক হইলেও নিজের বুদ্ধি দিয়া সে সব ম্যানেজ কইরা ফেলছে। বিসিএস দিয়া জনপ্রশাসন ক্যাডারে ঢোকার ইচ্ছা ছিল ওর। মেধাও ছিল মোটামুটি কিন্তু ক্যান জানি হয় নাই। রোকসানারে বিয়া করতে গিয়া এই নিয়া বেশ ভাল ধরনের প্যারায়ও পড়তে হইছিল। কারণ রোকসানার ফ্যামিলির বেশিরভাগ লোকজনই বিসিএস প্রশাসন। ওর বাপ তো কোনো এক মন্ত্রণালয়ের সচিবও ছিল! লোকে বলে খুব নাকি পাওয়ারফুল আমলা ছিলেন মোবারক সাহেব। তার কথায় এলাকার এমপি মন্ত্রীরাও নাকি মুতে দিত! উনি প্রায়ই বলেন, আজকাল নাকি তার লেভেলের অফিসার আর চোখে পড়ে না।
 
পলাশ বিসিএস দিছিল পাঁচবার। দুইবার প্রিলি, দুইবার রিটেন আর একবার ভাইভা পর্যন্ত টিকছিল। আরেকবার দেয়ার সুযোগ অবশ্য ছিল কিন্তু ও নিজেই আর দেয় নাই। রোকসানার পরিবারও ততোদিনে তাদের কন্যার গোঁ আর পলাশের লেগে থাকা দেখে মোটামুটি কনভিন্সড। পরে শ্বশুরের তদবিরে এজি অফিসের চাকরিটা হয়ে যায় পলাশের। ঘরজামাই থাকার অফারও পাইছিল অবশ্য কিন্তু অফারটা নেয় নাই সে। পলাশের ধারণা ওর চেহারা সুরত আর সূক্ষ্ণ বুদ্ধির কারণেই রোকসানার বাপ সাবেক সচিব মোবারক সাহেব বিয়েতে রাজী হতে বাধ্য হন।
 
নাশতা দিছিভেতর থেকে রোকসানার গলা ভেসে আসে। ভাবনার তাল কেটে যায় পলাশের। রোকসানার গলাটা খুব সেক্সি। হাস্কি টাইপের। এই গলাটার কারণেই ওর প্রেমে পড়ছিল পলাশ। চেহারাটাও মাশাল্লাহ। আর বুদ্ধি তো ওর চাইতেও আরেক লেভেল বেশি। ভাবে সব মিলায়া ভালোই চলতেছে  জীবন। মনে মনে আলহামদুলিল্লাহ পড়ে পলাশ।
 
নাশতা সেরে শার্ট ইন করতে করতে পলাশের মনে হইল ভুড়িটা বেশ বাইড়া গেছে। মাথায় টাকের আনাগোনা আর পেটের বাড়ন্ত স্বভাব নিয়া হালকা টেনশনে আছে সে বেশ কয়েকদিন যাবত৷ অফিসেও মেজাজটা ইদানীং ক্যান জানি খিটখিটা হয়ে থাকে। বিভিন্ন কাজে আসা বিসিএস ক্যাডারদের সাথে বলতে গেলে বেশ বাজে ব্যবহারই করে সে। এমনিতে তো বিসিএস অফিসার হইতে না পারার একটা আক্ষেপ আছেই তার উপর টাক, ভুঁড়ি, জলপাই গাছের বদখত কাক, তার কর্কশ ডাক ইত্যাদি নিয়া একটা বিচ্ছিরি অবস্থা যাইতেছে ওর।
 
এজি অফিসে সরকারি ক্যাডারগুলার জন্য আলাদা আলাদা সেকশন করা আছে। পলাশ দেখে স্বাস্থ্য ক্যাডার সেকশন। সরকারি ক্যাডারগুলার মধ্যে সবচেয়ে বালছাল অফিসার এই ক্যাডারের। এদের নিয়া ফুটবল খেলতে খুব ভাল্লাগে পলাশের৷ বলদের বলদ এরা। সারাদিন কাম করে, সারাজীবন পড়াশোনা করে কিন্তু টাকা-পয়সার হিসাব আসলেই খাড়ার উপর মুইতা দেয়। পলাশ খেয়াল কইরা দেখছে স্বাস্থ্য ক্যাডারের অফিসাররা ওদের খুব ভয় পায়। সাধারণত অন্য ক্যাডারের অফিসারদের সাথে একজন না একজন হইলেও কোন সহকারী থাকে কিন্তু এদের সাথে কেউ থাকে না। এরা একাই আসে। আইসা ভ্যাবলার মত টেবিলের সামনে দাঁড়াইয়া সালাম দিয়া নিজেদের পরিচয় দেয়৷ ঘুষ অফার করে। পলাশ ভাই পলাশ ভাই করতে করতে মুখে ফেনা তুইলা ফালায়। ভালোই লাগে পলাশের। প্রায়ই ভাবে প্রশাসন ক্যাডারে যাইতে পারলে এগুলারে ক্যাডার থেকেই বাদ দিয়া দিত। কিন্তু তখনই মা’র কথা মনে পড়ে ওর। ওর মা চাইত যে পলাশ বড় হয়ে ডাক্তার হবে। একারণেই ক্যান জানি ডাক্তারদের প্রতি একটা সফট কর্নারও আছে পলাশের। তাছাড়া এজি অফিসে চাকরির কল্যাণে অনেক বড় বড় ডাক্তারদের কাছে ভিআইপি সার্ভিসও পায় পলাশ। বিপদে আপদে ফ্রি তে দেখাইতে পারে। টেস্টের খরচটাও মাফ। কেউ কেউ তো ওষুধটা পর্যন্ত ফ্রি দিয়া দেয়। ওর অনেক ডাক্তার ফ্রেন্ডও ওর মত ট্রিটমেন্ট ওদের নিজেদের কলিগদের কাছেই পায় না!
 
কিন্তু সমস্যা হইল ডাক্তারদের এত খাতির-যত্ন পাইলেও পলাশ মনে মনে ঠিকই জানে যে, তারা আসলে ওরে এক পয়সা দিয়াও গুনে না। ওর কাছে অফিসের জানালার বাইরে জলপাই গাছের ওই দাঁড়কাকটা যেমন বিরক্তিকর, ডাক্তারদের কাছে সেও তেমনই কিংবা তার চাইতেও জঘন্য কোন প্রাণী। পলাশের ধারণা ঘুষ কম নেয় বইলাই তার এই দশা। সে যদি বড় অঙ্কের ঘুষ নিত তাইলে এই সাইলেন্ট তাচ্ছিল্য তারে কেউ করতে পারত না। ঘুষ বেশি খাইলে লোকে সত্যি সত্যি ভয় পায়, ক্ষমতাশালী মনে করে।
 
তাচ্ছিল্যের একটা ঘটনা মনে পড়ে যায় পলাশের। এই দিন কয়েক আগের ঘটনা। লাঞ্চের সময় এক ডাক্তার ঢোকে তাদের রুমে। লিয়েনে বড় একটা আন্তর্জাতিক সংস্থায় চাকরি শেষে সরকারি চাকুরিতে যোগ দিয়েছে। সরকারি বেতন সংক্রান্ত কাজে পলাশের ডেস্কে আসে সে। সম্বোধন করে পলাশ সাহেব। বসতে বললেও বসে না। এই কাগজ সেই কাগজের বাহানা করলেও পেশাদারিত্বের সাথে সব ঠিকঠাক দেয়। শেষমেষ কিছুতেই যখন ঘুষের আলাপে যাইতে পারছিল না তখন তারে নীচু গলায় পলাশ বলে, ‘হিসাবের ব্যাপার তো স্যার। কিছু খরচ লাগত। কোন দ্বিধাদ্বন্দ্ব না করে অফিসারটি বলে, ‘চিন্তার কিছু নেই। পেয়ে যাবেন। যে নাম্বারটা দিলেন সেটা কি হোয়াটসঅ্যাপে আছে?’ পলাশ জানায়, আছে। এর কিছু পরেই উনি চলে যান। হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ আসে পলাশের, ‘কত টাকা লাগবে জানায়েন। বিকাশ নাম্বারটা দিয়েন। মেসেজটা যেন ঠিক বিচিতে গিয়া লাগে পলাশের। না পারে সইতে না পারে গিলতে। মনে হয় উইড়া গিয়া চেঁচাইতে থাকা দাঁড়কাকটারে ধইরা ছিঁঁড়ে-খুঁড়ে ফেলে কিন্তু পারে না। তবে অফিস শেষে রঞ্জিতের দোকান থেকে কেনা অ্যাগ্রা বড়ি খেয়ে রাতে রোকসানারে ছিঁড়ে-খুঁড়ে ফেলে ঠিকই।
 
কিন্তু একটা সমস্যা আছে পলাশের। অন্তত ওর তাই মনে হয়। মেয়েটা পাশে থাকলে ঠিকঠাক লাগাইতে পারে না। কেমন জানি অসাড় হয়ে আসে সব। সেক্স জিনিসটা কি পশুত্ব নাকি প্রেম, কে জানে? পলাশের কাছে প্রেম একটা সুইট কিউট বিষয় আর সেক্স মানে পেশি, ঘাম, ক্ষিপ্রতা, হিংস্রতা, আদিমতম উত্তেজনা— অনেকটা মৃত্যুর কাছাকাছি কিছু— ভয়ংকর অথচ মধুরতম কোন বেদনা! এইসব ভাবতে ভাবতে পলাশের মনে পড়ে যায় রেণুর কথা। মনে পড়ে যেদিন রেণুকে প্রথম চুমু খেয়েছিল সেদিন অপরাধবোধে নিজের হাত কেটে ফেলেছিল ব্লেডে।
 
পলাশ ভাই, কি ভাবতেছেন? ফাইলটা সেই কখন দিয়ে গেছি। কিছু কি আগাইল?’ আচমকা বিলকিস খানমের গলা শুনে হুঁশ ফেরে পলাশের৷ অফিসে কখন আসল মনে করতে পারে না।
 
আমি কি নাক ডাকতেছিলাম?’ উলটা অফিস সহকারী বিলকিস খানমরে প্রশ্ন করে পলাশ।
 
তা তো ডাকতেছিলেনই! সারারাত ভাবিরে জাগায় রাখলে তো এমনই হবে! কণ্ঠে দুষ্টুমি নিয়া টেবিলে দুই হাত রেখে পলাশের দিকে ঝুঁকে বলে বিলকিস খানম। ওর থেকে মাত্র এক বিঘত দূরত্বে বিলকিস খানমের মুখ। হিজাবে মোড়ানো। ঠোঁটে সস্তা ব্র‍্যান্ডের লিপস্টিক তবে দেখলে বোঝা যায় না। অনলাইনে অর্ডার দিয়া কিনে দিছিল পলাশই। বিলকিসই পাঠাইছিল লিংকটা। কি জানি নাম ব্র‍্যান্ডটার! সম্ভবত ইন্ডিয়ান একটা ব্র‍্যান্ড। বিলকিসের বয়স কম। মাত্র ছয়মাস হল এই অফিসে আসছে। স্বামীও সরকারি একটা অফিসে অফিস সহকারী কাম ডাটা অপারেটরের কাজ করত৷ বিলকিসের একটা বিয়া হইছিল আরও ছোটবেলায় একটা প্রবাসী ছেলের সাথে। পরে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। ছেলেটার নাকি মেশিনে সমস্যা। বিলকিস সেরকমই বলে। এইটা তার দ্বিতীয় স্বামী। কিন্তু ট্র্যাজেডি হইল বিয়ের দিন কয়েক পরেই তার একটা ব্রেন স্ট্রোক হয়। এখন বাসাতেই থাকে। চার হাতপা প্যারালাইজড৷ বিলকিসের ঠোঁটের লিপস্টিকের রঙ দেখতে দেখতে পলাশের প্রথম দিনের কথা মনে হয়। প্রথম দিন মানে প্রথম যেদিন সে বিলকিসরে লাগাইছিল সেদিনের কথা। এই অফিসেরই একটা পরিত্যক্ত টয়লেটে। বিলকিস এখন ঠিক সেইম পজিশনেই ওর সামনে দাঁড়ায় আছে।
 
তোমার কি কোন লজ্জাশরম নাই? অফিস ভর্তি লোকের সামনে কি বল এগুলা! লো ভলিউমে বলে পলাশ, ‘
আমি কি পাগল যে রোজ লাগাব? আমিও তো মানুষ নাকি?’

 
তা তো বটেই! খালি ওইসময় মনে থাকে না যে আমরাও মানুষ। বিলকিসও পলাশের মতই ফিসফিস করে বলে, ‘অনেকদিন হয়ে গেল কোথাও বেড়াইতে যাই না। চলেন না কোথাও যাই।
 
পলাশ তার দুই উরুর ফাঁকে উষ্ণতা বাড়ার আভাস পায়। জানালা দিয়া কানে আসে খবিশ কাকটার কর্কশ ডাক৷
 
ফাইলটার কাজ শেষ। নিয়া যাও। আর শোন, আজকে আর কোন ফাইল আনবা না! আমি একটু আগে বাইর হব। তাছাড়া মাথাটাও ধরছে খুবএবারে স্বভাবসুলভ আওয়াজে কথা বলে পলাশ।
 
বিলকিস খানমও ফাইলটা হাতে নিয়া ঝোঁকা অবস্থা থেকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে, ‘হুম মাথা তো ধরবেই.... এইটুকু বলতেই গলা খাঁকাইয়া পলাশ বলে, ‘যাও তো এখান থেকে। খালি আজেবাজে কথা।
 
বিলকিস আর সাহস পায় না। ঠোঁটটা বাঁকা করে দ্রুত ঘুরে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। পলাশ ওর সুডৌল পাছাটার দিকে তাকায় থাকে। মনে করার চেষ্টা করে তিলটার কথা৷ লাল রঙের বড় একটা তিল। ডানে না বামে ছিল ঠিক মনে করতে পারে না। জলপাই গাছ থেকে আবারও ভেসে আসে কাকটার আর্তচিৎকার। শালার তো ভালোই গরম উঠছে মনে হচ্ছে
, বিড়বিড় করে বলে সে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ