চলে যায় যদি কেউ বাঁধন ছিড়ে ✺ মামুন
রশীদ
ভালো
কবিতা,
সৎ কবিতা চিনিয়ে দিতে হয়। পাঠকের কাছে সরাসরি কবির পৌঁছানোর
সুযোগ খুব কম। এক্ষেত্রে ভালো কবিতার সন্ধান দেন প্রকৃত সমালোচক, তিনিই পাঠককে উদ্বুদ্ধ করেন প্রকৃত কবিতা সম্পর্কে। আক্তারুজ্জামান
লেবুর সঙ্গে পরিচয় ছিল না। তার কবিতার সঙ্গেও না । কিন্তু লেবুর কবিতার সঙ্গে
আমার সংযোগ ঘটিয়ে দেন কবি ইমতিয়াজ মাহমুদ। তিনি আক্তারুজ্জামান লেবুর একটি কবিতা
তার ফেসবুকের দেয়ালে পোস্ট করেন। কবিতাটি আমাকে চমকে দেয়। ব্যস্ততার মাঝেও মনে
মনে লেবুর আরও কবিতার সন্ধান করতে থাকি। এরই মাঝে লেবুর আরও একটি কবিতা ফেসবুকে
নিজের দেয়ালে পোস্ট করেন কবি ফরিদ কবির। যথারীতি এ কবিতাটিও আমাকে আকৃষ্ট করে,
পাঠমুগ্ধতা তৈরি হয়। দু’জন কবি ―আক্তারুজ্জামান
লেবুর কবিতা সম্পর্কে আগ্রহ তৈরি করে তাদের ব্যক্তিগত ভালোলাগা আমাদের সঙ্গে বিনিময়
করেন,
ভালো কবিতাকে চিনিয়ে দেন। তবে সঙ্গে আরও একটি বার্তাও আমাদের
কাছে পৌঁছে, লেবু কর্কট রোগাক্রান্ত। যা একইসঙ্গে মনের
ভেতরে তৈরি করে বেদনার নীল ক্ষত। মানুষ মূলত আশাবাদী, আমরা
বুক বাঁধি― লেবু
সুস্থ হবে। লিখবে আরও অসংখ্য কবিতা, বেঁচে
থাকবে কবিতায়। মাত্র দুটি কবিতার বই― ‘না জল না
অনল’ এবং ‘দুষ্পাঠ্য দুটি চোখ’।
২.
সমসাময়িক
থেকে চিরন্তনে পৌঁছানোর চেষ্টা ছিল আক্তারুজ্জামান লেবুর কবিতায়। চেনা পথের ভেতর
দিয়েই সমসাময়িকতাকে জীবনের ঘনিষ্ঠতাকে অনুধাবনযোগ্য করে তোলার স্বাচ্ছন্দ্য
শক্তি ছিল লেবুর। সেই শক্তিকেই নিশ্চিন্তে কাজে লাগিয়েছেন তিনি। ফলে সহজবোধ্য করে
উপস্থাপন কৌশলের সঙ্গে তিনি ব্যক্তি জীবনের অনেক সাময়িক প্রসঙ্গকেও তুলনাহীন করে
তুলেতে পেরেছেন।
আধুনিক
কবিতার শরীর থেকে ব্যক্তি আমি ও তুমিকে সযত্নে সরিয়ে ফেলার যে প্রয়াস , কবিতাকে স্মার্ট করে তুলতে আবেগকে এড়ানোর নানা কলাকৌশল― লেবুর পক্ষপাত এসবে ছিল না। হৃদয়ের রক্তক্ষরণকে
প্রাধান্য দিয়ে আমিত্বময় কবিতারই সন্ধান করেছেন তিনি। সেখানে কবিতার সন্ধানে
কোনো উদভ্রান্তি তার ভেতরে ক্রীড়াশীল ছিল না । ফলে শেষ পর্যন্ত চমকপ্রদ দক্ষতায়
তার কবিতা হয়ে উঠেছে সুখপাঠ্য। একটি উদাহরণ দেই―
‘মানুষের দূরে
সরে যাওয়া দেখি
চেনা মুখগুলো অচেনা
রং ধরে চেয়ে থাকে
নিতান্ত কাছের কারো
ছলোছলো চোখ
একটু প্রশান্তির
সুবাস ছড়ায়
মানুষ এমন ভাব ধরে
থাকে
এমন তাচ্ছিল্য উদগীরণ
করে
যেন এ পথে ঘাটে কেউ
কোনদিন
এমন আগুন কেউ দেখবে
না চোখে’
কবিতা
সৃষ্টির জন্য যে সাধনা, যে স্বেচ্ছাবৃত আত্মদহন প্রয়োজন,
তাকে ধারণ করেই লেবু তার মনের বিক্ষিপ্ততাকে সংহত করেছেন।
বিশুদ্ধ কাব্যচর্চার ক্ষেত্রে লেবু প্রাধান্য দিয়েছেন আবেগকে। তার কবিতায় ফুটে
উঠেছে রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শময় জগতের প্রতি ভালোবাসা, মাটির টান।
সেখানে মাটি― পৃথিবীর
টানের প্রতি আস্থাই লেবুর আবেগকে সংহত করেছে, তাকে
দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে ব্যক্তির সার্বজনীন অনুভূতি । ক্ষণিক আবেগকেও লেবু এমন
গভীরতর রূপ দিয়েছেন যা থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখা যায়। না। প্রতিটি মানুষই জানে তার
পরিণতি, তার গন্তব্য । কিন্তু দিনক্ষণ নির্দিষ্ট করা থাকে
না বলেই স্পন্দমান জীবনের আনন্দকে আমরা উপভোগ করি।
আমরা
নিরাসক্ত থাকতে পারি জীবনের নানা বিষয়ে। এক্ষেত্রে লেবুর অভিজ্ঞতা ছিল ভিন্ন।
ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতায় সে জেনেছিল সময় কিভাবে ফুরিয়ে আসে। নিরুপায় মানুষ
কেমন বিভৎস কষ্টের ভেতরে ধীরে ধীরে মৃত্যুর জন্ম হতে দেখে । প্রকৃতির এই মৌল
সত্যকে আক্তারুজ্জামান লেবু দেখেছেন ব্যক্তিগতভাবেই। তার ভেতরে গড়ে উঠতে থাকা
জীবনাদর্শে মানুষের অসহায়ত্বকে, প্রকৃতির
অলঙ্ঘনীয়তাকে তীব্র আশায় দৃশ্যমান করে তুলেছে। সহজাত নিয়মে পৃথিবীর যে অবয়ব
আমাদের সামনে, তার মর্মান্তিকতাকে উপলব্ধি করেও, মানবজীবনের অসম্পূর্ণতাকে লালন করেই জীবনকে নবরূপে রূপায়িত করে তোলার
আশা তার ভেতরে ক্রিয়াশীল ছিল। যা সকল সহানুভূতিকে উপেক্ষা করে জীবনকে পরিপূর্ণ
করে তোলে সমর্পণের জন্য। তাই তিনি বলতে পারেন―
‘এই যে তুমি
পরম যত্নে বুকের কাছে বই নিয়ে হাঁটো
ষোড়শী
এ জন্য তো আমি বই হয়ে
জন্মাতে চেয়েছিলাম’।
মাত্র
আঠাশ বছরে চলে যাওয়া। মহাকালে দাঁড়িয়ে তা একটি বিন্দুও নয় । এই ক্ষুদ্র সময়েও
বাংলা কবিতার ভাণ্ডারে যে কয়েকটি লাইন আক্তারুজ্জামান লেবু যোগ করে গেলেন―
সকল বাঁধন ছিঁড়ে তার চলে যাবার পড়েও মনে রাখার জন্য, বেঁচে থাকার জন্য , এটুকুই ঝলমল করতে থাকবে ।
0 মন্তব্যসমূহ