স্মৃতিতে কবি আক্তারুজ্জামান লেবু ✺ কামরুন
নাহার কুহেলী
প্রখর
রোদ,
মেঘাচ্ছন্ন নাকি ঝুম বৃষ্টি―
কেমন দিন ছিল সেদিন যেদিন প্রথম কবি আক্তারুজ্জামান লেবুর সাথে দেখা হয়েছিল মনে নেই।
বগুড়া লেখক চক্রের কোন একটা অনুষ্ঠান ছিল। পাশ থেকে আপু বলে ডেকে লাজুক হেসে পরিচিত
হয়েছিল। তারপর মাঝে মধ্যে দেখা হতো, কথা হতো।
এভাবে কবিতাতো ছোট ভাই হয়ে গিয়েছে লেবু। সময় সময়ের মতো দ্রুত চলতে থাকে,
লেবুর বগুড়ার পাঠ চুকে যায়। একদিন স্কুলে থাকতে কিংশুক ফোনে
লেবুর জন্য ভালো ডাক্তারের খোঁজ করতে বলে। এর কিছুদিন আগেই বুকে ব্যথার জন্য
হার্টের ডাক্তারের পরামর্শ নিয়েছে লেবু। টেস্টের সব রিপোর্ট ভালো, হার্টের কোন সমস্যা নেই। কিন্তু ব্যথা ভালো হয়নি বরং পেটের দিকে নেমে
এসেছে । এরপর গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিশেষজ্ঞ দেখানো শুরু হলো বগুড়া-রংপুর। কিন্তু
ব্যথা যায় না। আমি মনে করি ওষুধ ঠিক মতো খায় না। বকা দেই। একেকজন একেকরকম
পরামর্শ দেয়― এটা
খাও,
ওটা কর। ডাক্তার কোন সমস্যা না পেয়ে মনে করে ব্যথা ওর মনের তৈরি,
মানসিক রোগের ডাক্তার দেখাতে বলে। শুনে লেবু রাগ করে। একসময়
ডাক্তারকে চাপ দিয়ে এন্ড্রোসকপি আর সিটি স্ক্যান লিখে নেয় লেবু। খুব অসন্তোষের
সাথে ওই দুটি টেস্ট করতে দেয় ডাক্তার। সিটি স্ক্যানেই রিপোর্টেই পায়ুপথে টিউমার
মানে কোলন ক্যান্সারের বিষয়টা ধরা পড়ে।
আমরা
ভীষণ বিস্মিত হই ওর বয়স, জীবন যাপনের ধরণে এ রোগ
হবার কথা নয়। তবু কেন ? অনেক কেন জমা হতে থাকে। কোন
কেনোর উত্তর পাওয়া যায় না। চিকিৎসা শুরু হয়। অনেক মানুষ লেবুকে ভালোবেসে
সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়, অনেকে কটাক্ষ আর তাচ্ছিল্য
করে আমাদের। তবু আমরা ভীষণ আশাবাদী হই লেবু সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ফিরবে মায়ের কাছে,
আড্ডায়, কবিতায়। লেবুও নিশ্চয়
আশাবাদী ছিল জীবনের কাছে ফেরার। তাইতো ওর যেদিন ইন্ডিয়ায় যাবার ফ্লাইট ছিল
সেদিনই ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের ( সম্ভবত ) এডি পোস্টের চাকুরির পরীক্ষা । পূর্বের
রাতে দেখা করতে যেয়ে দেখি পড়ছে। ও পরীক্ষা দিয়ে যেতে চায়। ঢাকার জ্যাম,
আসা যাওয়ার সময় হিসেব করে দেখা গেল পরীক্ষা দিলে ফ্লাইট মিস
হবার সম্ভাবনা থাকে। ইন্দ্ৰজিৎ পরীক্ষা দিতে নিষেধ করলে খালাম্মা, চাচা, আমি সমর্থন করলাম।
ইন্ডিয়া
থেকে চিকিৎসা নিয়ে ফিরে আসার পর ওর সাথে দেখা করে খুব খুশি হয়েছিলাম―
কী সুন্দর হয়েছিল দেখতে। মনে হয়েছিল সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গিয়েছে। ক’মাস পর ফলোআপের জন্য আবার যাবার কথা ছিল। কিন্তু কোভিড-১৯ আর সুযোগ না
দিয়ে সব স্বপ্ন― আশা
ভেঙে দিল। গত ২ জানুয়ারি যখন ওদের বাড়িতে গেলাম ওর সাথে আড্ডা দেয়ার জন্য, ও তখন কথা বলতে পারছিল না। ভীষণ ব্যথায় প্রায় সারাদিন দাঁতে দাঁত
চেপে কুণ্ডলী পাকিয়ে থাকল। সেদিন ওর যন্ত্রণাকাতর কুণ্ডলী পাকানো শরীর দেখে খুব
আশাহত হলাম । ওর পাশে বসেই ওর ফাইলগুলো ঘেঁটে অনেকটা সময় ধরে ইন্ডিয়ায় যাবার
জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পৃথক করল হারুন। কত কাগজ। সারাজীবনের শিক্ষার সনদ,
চাকুরির পরীক্ষার কাগজ, ট্রেড লাইসেন্স,
ব্যাংকের কাগজ সব কেমন অপ্রয়োজনীয় মনে হতে থাকে আমার । আহা রে
জীবন!
ওর
সাথে কেউ দেখা করতে গেলে কী যে খুশি হতো। অসুস্থ শরীর নিয়েও নিজেই তদারকি করতো, খালাম্মার সাথে রান্নাঘরে খুটখাট ছোটাছুটি করে এটা সেটা কত কী খেতে
দিত। না খেতে চাইলে মন খারাপ করতো আবেগী ছেলেটা ।
সেদিন
ছিল ২১ মার্চ। রবিবার । ঘড়ির কাঁটা দুপুর ২ টা পেরিয়েছে মাত্র কিংশুক ফোনে ওর
চলে যাবার খবর জানাল। কবি আক্তারুজ্জামান লেবু মাত্র ২৮ বছরে চলে গেল তার কবিতায়
বলা ‘অসমাপ্ত গদ্যের মতো’ জীবন থেকে। যাপন করে গেল ‘বিরামচিহ্নের পরে যেটুকু অবকাশ’ সেটুকুই ।
বিরামচিহ্নের
পরের অবকাশ ঘুরতে থাকে আমার মাথার ভেতরে। আবার প্রশ্নগুলো চিৎকার করে কেন কেন কেন ? লেবুহীন ওর বাড়িতে গেলে খালাম্মা জড়িয়ে ধরে কাঁদে, বলে― আমাকে
দেখার কেউ থাকল না মা। কিছু বলতে পারি না। মিথ্যা সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা আসে না। লেবুর
শূন্য ঘর বুকের ভেতর হাহাকার করে। স্মৃতিগুলো ডানা ঝাপটায়। আর কোথাও কোনদিন সামনে, পিছনে বা পাশ থেকে ‘আপু’ বলে ডেকে উঠবে না লেবু । মেনে নিতে পারছি না ।
0 মন্তব্যসমূহ