‘দুষ্পাঠ্য দুটি চোখ’ কবিতাগ্রন্থটি
ব্যক্তিগত অসহায়ত্ব, কাতরতা আমাদের সমাজের প্রতিরূপ
✺ ফেরদৌসী রুম্পা
আক্তারুজ্জামান
লেবু নামটি শুনলেই কি এক অদ্ভুত কারণে আমার বারবারই আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের নামটি
মনে পড়ে। অনেকটা নামের অভিন্নতার জন্যই এমনটা হতে পারে, যদিও দু’জনের মাঝে মিল খুব কমই। একজন
কালোত্তীর্ণ কথাসাহিত্যিক, যিনি সারাজীবনের সাধনায় মাত্র
দু’টো উপন্যাস লিখেই বাংলা সাহিত্যে অমরতা লাভ করেছেন।
তার রচিত সাহিত্যে শিল্প বিষয়টি
স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। আর অন্যজন উদীয়মান কবি, যার মাত্র
সাতাশ বছর বয়সেই ইতোমধ্যে দুটো কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে এবং যার কবিতায় অনেকটা
জীবনানন্দ দাশের রচনার মতো ভাঁজে ভাঁজে রয়েছে বেদনার আলতো প্রলেপ কিংবা
অনেককিছুই না পাওয়ার যন্ত্রণা বা ব্যর্থ প্রেমের অনাকাঙ্ক্ষিত সমাপনি বার্তা। কিন্তু এতোটা
অমিলের মাঝেও দু’জনের মাঝে এক মর্মান্তিক মিল হচ্ছে তারা
উভয়ই দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত! একজন তবুও জীবনের অনেকটা পথ হেঁটে যাওয়ার সুযোগ
পেয়েছেন। কিন্তু অন্যজন! জীবনতরী চলা শুরু করার পরপরই মাঝি পাল না ওড়াতেই বদলে
যাচ্ছে নদীর বাঁক, স্রোতে হারিয়ে যাচ্ছে দিশা আর হতবিহ্বল
মাঝি পথ হারিয়ে নৌকা নিয়ে এদিক-ওদিক ছুঁটে যাচ্ছে। আর একটি অন্যতম মিল হচ্ছে উভয়ই
একই জেলাভূক্ত।
যাহোক, কবি আক্তারুজ্জামান লেবু’র দ্বিতীয়
কবিতাগ্রন্থ ‘দুষ্পাঠ্য দুটি চোখ’। বইয়ের উৎসর্গপত্র পড়লেই বইয়ের নামকরণ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে।
তিনি
লিখেছেন,
‘যিনি আমায়
পড়তে শিখিয়েছেন প্রথম,
কিন্তু সারাজীবন তার
চোখদুটোই পড়তে পারিনি আমি।
আমার বাবা।’
বাবার
দুষ্পাঠ্য দৃষ্টিতে পৃথিবী চেনার আগেই নির্মম বাস্তবতায় তিনি পৃথিবীর অদেখা
সত্যগুলোকে চোখ বন্ধ করে দেখে নিয়েছেন।
‘আমি তো
ভাই কবরের উপর বেড়ে ওঠা ঘাস
আমায় তুমি শেখাতে এসো না
লাশের দীর্ঘশ্বাস।’
‘বাবাকে
বেচে খেয়েছি অনেক দিন
তার দুষ্পাঠ্য দুটি চোখ আর
অসহায় দুপুগুলোকে
আমি আর কারোর কাছে বেচবো না
ভেবে চুপ করে থাকি।’
উপরোক্ত
লাইনগুলের মতোই কবি তার বইয়ের উর্বর ভূমিতে দুঃখ-কষ্টের বীজ বপন
করেছেন।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বেঁচে থাকলে হয়তোবা তাকেও জীবনানন্দের মতো ‘দুঃখ রূপময়’ ধরনের কিছু একটা বলতেন!
পরিবারের
একমাত্র উপার্জনক্ষম; বেকার যুবক সন্তান যখন
ব্যথায় ঘুমহীন রাত্রিযাপন করে তখন কবিতায় দুঃখ রূপকতা থাকবে একটাই স্বাভাবিক। যার
রক্তে-মাংসে কবিতার রস ছোটাছুটি করে তার দুঃসময়ে কবিতা থাকবে না এমনটা কি করে হয়! কবি
আক্তারুজ্জামান লেবু’কে যদি কোনো ব্যক্তি হিসেবে না দেখে
সমাজ বা রাষ্ট্রের বিবেক হিসেবে কল্পনা করা যায়, তখন খুব
সহজেই আমাদের দেশের বাস্তব চিত্র প্রতীয়মান হয়।
‘মা,
আমার সামনে তোমার চোখদুটো কি গোপন করা যায় না?
আমার কাছে ওই চোখদুটো
যে তোমার বেদনা দেখার আয়না।’
কবিতাগুলোয়
আপাতভাবে ব্যক্তিগত অসহায়ত্ব, কাতরতার কথা থাকলেও
এই ব্যর্থতা আমাদের সমাজের নয় কি!
কবি আক্তারুজ্জামান লেবু’র স্মরণে অরণ্যনদী’র অনলাইন বিশেষ সংখ্যা
0 মন্তব্যসমূহ