শিরিনের এমন বিধ্বস্ত চেহারা আমি কখনো দেখিনি। আমার চোখের সামনে সে এভাবে কখনো এমন দপ করে নীভে যায়নি। সংসার জীবনে তো কত কথাই হয়, হয়েছেও। কতো শত অবান্তর প্রশ্ন করে আমি ওকে রাগিয়েছি। ওর সুগভীর নাভীমূলের বর্ণনায় মিশিয়ে দিয়েছি ম্যানহোলের মতো বাজে উদাহরণ। সব উপেক্ষা করে ও শুধু নিমগ্নতায় হারিয়ে গিয়েছে। অথবা সরলতার গোপন সৌর্যে আমাকেই হারিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আজ ওর পাংশু বর্ণের মুখ দেখে আমার নিজেরই খারাপ লাগছে। ওর মুখের শুভ্র ক্যানভাসে আমি যেন ঢেলে দিয়েছি বিবর্ণ গরল। যদি জানতাম, আমার এইরুপ কৌতুহল প্রবণ প্রশ্নে সদা হাস্যজ্জল একটি মায়াবী মুখ এমন স্বর্ণপ্রস্রবী বিকেলেও চৈত্রের মাঠ হয়ে যাবে, নিশ্চিত কৌতুহলের কবর দিয়ে দিতাম।
কৌতুহল প্রবণতা আমার মাত্রার অধিক। স্কুল জীবন থেকে অনুভব করি। এ নিয়ে অসংখ্যবার কাছের বন্ধু-বান্ধবদের কাছে ট্রলেরও শিকার হয়েছি। সংসার জীবনে বেশি কৌতুহলী দম্পতির ইতিহাস যে মোটেই সুখকর হয় না, এই সাংসারিক গূঢ় তত্ত্ব জানা থাকা আমার খুব একটা কাজে লাগেনি। উপায় নেই, যা দেখি তাই কৌতুহল হয়ে ধেয়ে আসে।
শিরিনকে একা বাসায় রেখে অফিস করি। দু বছরের একটা মেয়ে আছে আমাদের। তাতে কি! ওকে নিয়ে শিরিন তো বাসায় একাই থাকে। অফিসটা বাসার কাছাকাছি হওয়ায় দুপুরে খেতে আসি। শিরিন দরজা খুলে দেয়। তখন যদি ওর চুল এলোমেলো দেখি আমার ভালো লাগেনা। ব্লাউজটা বেশি ভাঁজভাঁজ লাগলে আমার কপালে চরের বালির মতো ভাঁজ জাগে। আমি ওর ঠৌঁটের দিকে তাকাই। ওর পছন্দের কালো-খয়েরী লিপস্টিকের বর্ণ বেশি অনুজ্জল দেখালে আমার মন খারাপ হয়। যদিও আমার পছন্দ গোলাপী। আমি শিরিনকে কোন প্রশ্ন করি না। শিরিন কি ভাববে এজন্য নয়। যদি উত্তরটা অগোছালো ভাবে দেয় আথবা উত্তর দিতে গিয়ে কথা জড়িয়ে আসে, তখন আমার কৌতুহল জাগবে। কাজে মন বসবে না। আমার বিকেলগুলো বিষণ্নতায় ছেয়ে যাবে। শিরিন আমাকে খাবার দেয়। আমি চুপচাপ খেয়ে যাই। প্রায় দুপুরেই খেয়াল করি, শিরিন একটু ভয়ে ভয়ে থাকে। আমি কখন আরেকটু ভাত চাইব, গ্লাসে পানি ঢালতে বলতে বলব, ও যেন প্রস্ততি নিয়ে রাখে। আামি ভাত খাই। ও আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি প্রশ্ন করি, কী দেখো? ও বলে, তুমি ছাড়া তো আর কেউ নেই এখানে, তোমাকেই দেখি। আমি আবার প্রশ্ন করি,কী ভাবো? শিরিন নিরুত্তর থাকে। আমি প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে মেয়েটার কথা জিজ্ঞেস করি। স্বর্ণালী কখন ঘুমায় আর কখনই বা ওঠে। ভোরে ঘুমোতে দেখে যাই। দুপুরে ও রাতে এসেও তাই দেখি। সপ্তাহে একদিন ও আমাকে দেখতে পায়। এভাবে চলতে থাকলে, একটু বড় হলে স্বর্ণালী আমাকে চিনবে তো শিরিন? আমি যে ওর বাবা বিশ্বাস করবে? শিরিন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। দৃষ্টি কার্পেটে ছড়িয়ে দিয়ে বলে, তুমি খুব ভালো ছেলে হাসান। আমি হা করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি। রাতে ফিরেও একই রকম দেখতে পাওয়ার কৌতুহল নিয়ে অফিসি ব্যস্ততায় ঘর ছাড়ি।
আমাদের বিয়ের দিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। বর্ষায় বৃষ্টি থেমে যাবার অপেক্ষায় বিয়ের দিন তারিখ কেবল পিছিয়ে যাচ্ছিল। দিন দশেক পেছানোর পর আর অপেক্ষা করা হয়নি। তারিখ ঠিক হয়ে গেল। বিরতিহীন বৃষ্টিতে বরযাত্রীদের দীর্ঘ দশ কিলো রাস্তা বেড়াল ভেজা হয়ে কাদা মাড়াতে হয়েছিল। রাস্তার এমন বেহাল দশা ছিলো যে, শুধু বরের রিক্সাটা তিনজন জোয়ান মরদ ঠেলে কনের বাড়ির উঠোন পর্যন্ত আনতে পেরেছিল। কাদায় জুতা হারানোর বেদনা ও লজ্জায় অনেককে কনের বাবার গোষ্ঠী উদ্ধার করতে হয়েছিল। আমি শিরিন কে দেখার জন্য এতই উদগ্রীব ছিলাম যে, রিক্সা থেকে বারবার মাথা বের করে দেখার চেষ্টা করতে গিয়ে পাগড়ী ভিজিয়ে ফেলেছিলাম।
বিয়ের আগে শিরিনকে আমার জানা ছিল না। ও যে বাবার বন্ধুর মেয়ে সেটাও জেনেছি বিয়েরে পর। ও আমার প্রথম নজরে আসে কনে বিদায়ের কিছুক্ষণ আগে। ওর শোবার ঘরের বারান্দায় মা-চাচী গোত্রীয় অনেকে কি যেন বোঝাচ্ছলি ওকে। ও যে কিছুই বুঝতে চাচ্ছিল না তা আমি বুঝেছিলাম। রাগ করে চুড়ি খুলে ফেলছে, আবার সেই চুড়ি পড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। শাড়ি খুলে ফেলতে চাইছে, সবাই বাঁধা দিচ্ছে। ওর গায়ে একজনকে হাত তুলতে দেখে আমি আবাক হয়ে গিয়েছিলাম। অদূর থেকে ওর পরাজিত হওয়া দেখে আমার খারাপ লাগছিল। কিছু কৌতুহলী প্রশ্ন আমাকে গিলে খাচ্ছিল।তারপর আমি খুব অপ্রীতিকর সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করি। আমার বড় বোনে স্বামীর হস্তক্ষেপে সে যাত্রায় থেমে যাই।
বিদায়ের সময় শিরিন যখন খুব কাছে আসলো,আমার সমস্ত রাগ, ক্ষোভ, কৌতুহল যেন কর্পূরের মতো উবে গেল। এতো সুন্দর মেয়ে এই প্রথম দেখা। ওর বেলুনের মতো নরম হাতের দিকে তাকাই। ছুঁয়ে দেখার সাহস হারিয়ে ফেলি। তারপর যখন শরতের সাদা মেঘের ওপর মেহেদী রঙের কারুকাজ খচিত হাতটি আমার হাতে ধরিয়ে দেওয়া হলো, আমি আর তাকাতে পারছি না। ওর মুখের দিকে চাই। শীতের পুকুরের মতো কালো গভীর দুটো চোখ ও বন্ধ করে রেখেছে। সমস্ত মুখমন্ডলে যেন সৌন্দর্যের ব্যাপন ঘটছে। অতঃপর রিক্সায় আমার বুকের সাথে শিরিনের ঢলে পড়া পর্যন্ত সব মনে করতে পারি।
বিবাহ পূর্ব ক্ষোভের রহস্য আমি আজ পর্যন্ত জানতে চাইনি। ভয় লাগে। যদি উত্তরটা এমন আসে পাছে আমার ভালোবাসা ও বিশ্বাসের অমৃতে না গরল হয়ে দাঁড়ায়! খুব ভালোবাসি ওকে। এই ভালোবাসাই নিঃসন্দেহে আমাকে অধিক কৌতুহলী করে তুলেছে।
শিরিন বাসার সমস্ত কাজ একাই করে। কাজে মেয়ে রাখে না। আমি জোর করে একবার কাজের মেয়ে রেখেছিলাম। মাস তিনেক ছিলো। তাতেই শিরিন হাঁপিয়ে উঠেছিল। শুধু বাবার বাড়ি যেতে চাইত। এটা ওর আমাকে নিয়ে সন্দেহের কারণ হতে পারে ভেবে আমি লজ্জিত হয়েছিলাম। অথচ মেয়েটা বিদায় হওয়ার এক বছর পার হতে চললেও, বাবার বাড়ির কথা ওর মুখে আসেনি। অদ্ভুত মেয়ে। একা থাকতে ভালোবাসে। এমন কি শপিং করতেও। কিন্তু আমার ভালো লাগে না। অফিস ডে তে ওর শপিং দরকার হলে আমি ছুটি নেই। আমি সাথে যাই। শিরিন আনইজি ফিল করে। আমি কারণ জানতে চাই না। আমি বিশ্বাস করতে চেষ্টা করি, শিরিন শুধু আমাকেই ভালোবাসে।
বৈশাখে ওদের বাড়ির পাশে বড় মেলা বসে। এসময় শিরিন বাড়ি যায়। তিনদিন থাকে। মেলায় ঘোরাঘুরি করে। বলে ছোটবেলার অভ্যাস। আমার এত ছুটি থাকে না। ফেরার সময় শিরিন একা আসে। কেউ এগিয়ে দিতে চাইলেও নেয় না। আসতে সন্ধ্যা পেরিয়ে যায়। আমি খুব বিশ্বাস করতে চেষ্টা করি। শিরিন অমন মেয়ে নয়। ও আমাকে ভালোবাসে। স্বণার্লীকে ভালোবাসে। বাসায় ফিরে ওর স্বাভাবিক হতে সময় লাগে। তিন দিন। অথবা সাতদিনের মতো। তারপর ফুলেরে পাঁপড়ীর মতো মেলতে শুরু করে। এসময় আমি বেশি বেশি গাছে জল দেই। নিজেই খাবার বেড়ে খাই। ডিটারজেন্টে কাপড় ভেজাই। স্বণার্লীকে আদর করি। অফিস করি। শিরিন স্বাভাবিক হয়ে গেলে এসব কাজে বাঁধা দেয়। কাজগুলো নিজে করে। মেয়েকে আদর করে। চুমু খায়। আমার বিশ্বাস ফিরতে শুরু করে। আমি দুষ্টোমী শুরু করি। শিরিন বাঁধা দেয় না । বলে, তুমি খুব ভালো ছেলে হাসান। ও সারা মুখে হাসি মেখে রাখে। আমি রোমান্টিক হয়ে পড়ি। বলি, চলো না এমন কিছু করি যাতে সারা জীবন পরস্পরকে মনে রাখতে পারি। শিরিনে মুখ থেকে হাসি মিলিয়ে যায়। শিরিনের চোখে নস্টালজিয়া দেখি। আমি তড়িঘড়ি প্রসঙ্গ পাল্টাই। বলি , দেখো দেখো মেয়েটা কথা বলতে শিখে গেছে। মামা ডাকছে। ওর তো মামাই নেই। বাবা শেখার আগেই মামা ডাকতে শিখে গেছে। তোমার মতোই অদ্ভুত হয়েছে। শিরিন স্বাভাবিক ভাবেই বলে, বাবা কেমনে শিখবে, তুমি তো ওর কাছেইে থাকো না। আমি বলে ফেলি, তাহলে মামা শিখলো কেমনে? শিরিন অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। আমি হো হো করে হেসে ওকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করি। বলি, ও মামা নয়, মা মা শিখেছে। তুমি মা হয়েও বুঝতে পারলে না, কেমন মা তুমি শুনি! হা হা হা...। শিরিনও হেসে ওঠে। আমি খুব জোরেসোরে নিজেকে বিশ্বাস করাতে চেষ্টা করি। শিরিন অমন মেয়ে নয়। ও শুধু আমাকেই ভালোবাসে। আমাকেই সময় দেয়। ওর সব ভালোবাসা শুধু আমিই ভোগ করি।
গত পরশু বাবার বাড়ি থেকে এসেছে শিরিন। রীতিমতো ওর স্বভাবিক হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছি। অথচ লক্ষ্য করছি ও যেন খুব স্বাভাবিক হয়েই ফিরে এসেছে। সবকিছুতেই ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। সব কথাই হেসে হেসে বলছে। আমার ভালো থাকা মন্দ থাকার খবর নিচ্ছে। কোনদিনও যে কথা জিজ্ঞেস করেনি- আমার অসুখ করেছিলো কিনা সে কথবাও জিজ্ঞেস করছে। আমার পছন্দের খাবার রান্না করছে, যে শার্ট পরে অফিসে যাবো সেটাও নির্ধারণ করে দিচ্ছে।
আজ ছুটির দিন। প্রখর সূর্যটা ক্রমশ দূর্বল হয়ে পশ্চিমের কোলে হেলে পড়েছে। এক অদ্ভুত মিষ্টি রোদ ধরণীর উত্তর গোলার্ধ স্বণার্লী করে তুলেছে। শিরিন লাল ব্লাউজের সাথে হলুদ শাড়ি পড়েছে। ঠোঁটের গোলাপি লিপস্টিক গাঢ় করে লাগিয়েছে। ব্যালকুনির গ্রীল বেয়ে যেখানে হলুদ আলো গলে পড়ে রোজ বিকেলে সেখানে দাঁড়িয়েছে। আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আজ সে অনেক কথা বলবে আমাকে। অথচ এমন কাঙ্খিত মুহূর্তে অবিবেচকের মতো কী প্রশ্নটাই না আমি তাকে করেছি। সৃজিত রঙিন বেলুনটা ফুটো করে আমি মোটেই শান্তি পাচ্ছি না। বিকেল রঙে রাঙিয়ে রাঙিয়ে শিরিন হয়তো অনেক কথাই বলতে চেয়েছিল কিন্তু কোন কথাই সে বলছে না।আমি যেন ভুল বাটনে চাপ দিয়ে আমারই গোচানো ফাইনাল পান্ডুলিপি ডিলিট করে দিয়েছি। অপরাধীর মতো ভিরু পায়ে ব্যালকোনি থেকে বিদায় নেব এমন সময় আমার হাত চেপে ধরে শিরিন। দাগী আসামীর মতো আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি অনুচ্চ স্বরে জিজ্ঞেস করি, এজন্যই কি তুমি ব্লাউজ না খুলে বিছানায় আসতে পছন্দ করতে? শিরিন চোখ নিচু করে হ্যাঁ-সূচক জবাব দেয়। বলে, সে আমাদের সম্পর্কটা এমন অশ্লীলভাবে স্মরণীয় করে রাখবে জানলে আমি তার কাছে ঘেঁষতাম না। মানুষের আদিম প্রবৃত্তির কাছে আবেক ও প্রেম বড়ই তুচ্ছ। অনেক চেষ্টা করেছি হাসান।সাপের কামড়ের ক্ষত একদিন মুছে যায়। মানুষের কামড়ের ক্ষত সহজে দূর করা যায় না, ক্ষতস্থান কেটে ফেললেও না। ও আমাকে শারীরিক ও মানসিক ব্যাধি দিয়ে গেছে। গত পরশু আমেরিকা চলে গেছে । আর আসবে না। তুমি খুব ভালো মানুষ। আমি শুধু তোমাকোই ভালোবাসতে চাই হাসান। ওর মুঠো থেকে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম তাহলে স্বর্ণালী? নিরুত্তরের বেদিতে দাঁড়িয়ে শিরিন চারিদিকে অন্ধকার খুঁজতে থাকে। আমি বললাম তুমি সত্যিই আমাকে ঠকিয়েছো শিরিন। এতদিনই ঠকিয়ে এসেছো। ততক্ষণে দূর্বল সূর্যটা গোধূলীকে আমন্ত্রণ জানিয়ে ফেলেছে। আবছা অন্ধকারে শিরিনের চোখদুটো চিকচিক করছে।
0 মন্তব্যসমূহ